হাওড়া জেলার  সংক্ষিপ্ত বিবরণ

পশ্চিমবঙ্গের ২৩ টি জেলার মধ্যে থেকে অন্যতম হল হাওড়া। এটি পশ্চিমবঙ্গের প্রেসিডেন্সি বিভাগের অন্তর্গত একটি জেলা। এই জেলার সদর শহর হল হাওড়া। আয়তনের নিরিখে হাওড়া জেলার আয়তন পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে অষ্টাদশ তম। ১৯৩৭ সালে হাওড়া জেলা স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আর ১৯৬৩ সালে হাওড়া জেলা প্রেসিডেন্সি বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হয়।

হাওড়া জেলার ইতিহাস

হাওড়া জেলার শ্যামপুর, জগৎবল্লভপুর, বাগনান ইত্যাদি জায়গায় খননকার্য চালিয়ে বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। এই জেলায় রয়েছে পোড়ামাটির কারুকার্যসহ বেশ কিছু প্রাচীন মন্দির। তবে এই জেলার উল্লেখ কোন পুরানে পাওয়া যায় না। এমনকি গ্রিক ও চীনা লেখকদের গ্রন্থেও এই অঞ্চলের কোন উল্লেখ পাওয়া যায়নি। তবে মনে করা হয়, প্রাচীনকালে রাঢ় বঙ্গের অন্তর্গত সুহ্ম অঞ্চলের দক্ষিণাংশ হাওড়া আর অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা নিয়ে গঠিত হয়েছিল।

খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে বর্তমান হাওড়া জেলার উলুবেরিয়া মহকুমার বেশ কিছু অংশ উড়িষ্যা রাজ্যের অধীনে ছিল‌। মধ্যযুগের সময়কালে পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রধান বন্দর ছিল সপ্তগ্রাম। অপরদিকে বিপ্রদাস পিপলাইয়ের ‘মঙ্গলচন্ডী’ কাব্যে বেতরের উল্লেখ রয়েছে। এছাড়াও ১৫৫৩ সালে ডি. ব্যারোজ একটি মানচিত্র এঁকেছিলেন। সেই মানচিত্রে হাওড়া জেলার কয়েকটি স্থানের উল্লেখ রয়েছে। পরবর্তী সময়ে রেনেলের মানচিত্র হাওড়া জেলার বেতর ও শিবপুরের উল্লেখ পাওয়া গেছে।

বিংশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত পৃথক জেলা হিসেবে হাওড়ার কোন অস্তিত্বই ছিল না। ১৭৬০ সাল নাগাদ হাওড়া জেলা বর্ধমানের অন্তর্গত হয়। ১৭৬৫ সাল নাগাদ এই জেলা ব্রিটিশদের অধিকারে চলে যায়। এরপর ১৭৯৫ সালে হুগলি জেলাকে বর্ধমান জেলার থেকে আলাদা করে দেওয়া হয়। ১৯৩৮ সালের ১ লা জানুয়ারি হাওড়া জেলা পূর্ণাঙ্গ জেলা রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।‌ আর ১৯৬৩ সালে এই জেলা প্রেসিডেন্সি বিভাগের অন্তর্গত হয়।

হাওড়া জেলার অবস্থান

হাওড়া জেলা দক্ষিণে ২২° ১২’ উত্তর অক্ষাংশ থেকে উত্তরে ২২° ৪৮’ উত্তর অক্ষাংশ পর্যন্ত ও পশ্চিমে ৮৭° ৫০’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ থেকে পূর্বে ৮৮° ২৩’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত অবস্থিত। এই জেলার উত্তরে হুগলি জেলা আর দক্ষিণে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা, কলকাতা ও পূর্ব মেদিনীপুর জেলা অবস্থিত। পূর্ব দিকে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা, কলকাতা ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা ও পশ্চিম দিকে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা অবস্থিত।

হাওড়া জেলার জনসংখ্যা

২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী এই জেলায় মোট ৪৮ লাখ ৫০ হাজার ২৯ জন মানুষ বসবাস করেন। তার মধ্যে থেকে ২২ লাখ ৪১ হাজার ৮৯৮ জন পুরুষ ও ২০ লাখ ৩১ হাজার ২০১ জন মহিলা। এই জেলার লিঙ্গানুপাত প্রতি ১ হাজার জন পুরুষে ৯৩৫ জন মহিলা।

হাওড়া জেলার ভূপ্রকৃতি

হুগলি নদী হাওড়া জেলার পূর্ব সীমানায় অবস্থিত। এই নদী উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও কলকাতা জেলার থেকে হাওড়া জেলাকে আলাদা করেছে। এই জেলার উত্তর ও উত্তর পশ্চিমাংশ সামান্য উঁচু। এখানকার মৃত্তিকা কঠিন কাঁদা দোঁয়াশ।

হাওড়া জেলার জলবায়ু

এই জেলার আবহাওয়া উষ্ণ ও আর্দ্র প্রকৃতির। এই জেলায় গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ ও শীত ঋতু অনুভব করা যায়। এখানে গ্রীষ্মকাল উষ্ণ প্রকৃতির হয়। গ্রীষ্মকালে এই জেলার সর্বাধিক তাপমাত্রা থাকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা থাকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে। আর শীতকাল এখানকার আবহাওয়া হয় শুষ্ক প্রকৃতির। এই সময় সর্বাধিক তাপমাত্রা থাকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা থাকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে।এই জেলায় সবথেকে বেশি বৃষ্টিপাত বর্ষাকালে হয়। হাওড়া জেলার বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১ হাজার ৪০০ মিলিমিটার থেকে ১ হাজার ৬০০ মিলিমিটার।

হাওড়া জেলার নদ-নদী

এই জেলায় একাধিক নদী বয়ে চলেছে। তবে প্রধান নদী হল – রূপনারায়ণ, দামোদর, হুগলি ও সরস্বতী। এই জেলার পূর্ব প্রান্তে হুগলি নদী প্রবাহিত হয়। আর পশ্চিম প্রান্তে প্রবাহিত হয় রূপনারায়ণ। আর দামোদর নদ জেলার মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গেছে। এই নদের দুটি শাখা‌ নদী – কানা দামোদর ও পুরোনো দামোদর এই জেলার ওপর দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে। তাছাড়াও এই জেলায় রয়েছে প্রচুর খাল ও খাড়ি। জোয়ার ভাটা এই জেলার নদীগুলিতে পরিলক্ষিত হয়। বর্ষাকালে এই জেলার নদীর পাড়ে ভাঙ্গন দেখা দেয় আর বন্যা হয়।

হাওড়া জেলার ভাষা

হাওড়া জেলার প্রধান ভাষা বাংলা। এই জেলার ৮৪.৯৯ শতাংশ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। আর ১১.২৭ শতাংশ মানুষ হিন্দিভাষী। এছাড়াও ২.৮৬ শতাংশ মানুষ উর্দু ভাষায় কথা বলেন।

হাওড়া জেলার দর্শনীয় স্থান

হাওড়া জেলায় একাধিক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। যেমন –

১. বেলুড় মঠ :-

বেলুড় মঠ হল রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান কার্যালয়। এটি ১৮৯৭ সালে স্বামী বিবেকানন্দ হাওড়ার বেলুড়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটি গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত। এই মঠ প্রায় ৪০ একর জমির ওপর অবস্থিত। প্রতিদিন বহু দর্শনার্থী বেলুড় মঠ ভ্রমণ করতে যান। এছাড়াও এই মতে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ইতিহাসসহ রয়েছে একটি সংগ্রহশালা। তাছাড়া রামকৃষ্ণ মিশন অনুমোদিত বেশ কিছু শিক্ষা কেন্দ্র রয়েছে বেলুড় মঠ সন্নিহিত প্রাঙ্গণে। এছাড়াও রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয় বেলুড় মঠের প্রাঙ্গনে অবস্থিত। এই মঠের নকশা নির্মাণ করেছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের শিষ্য স্বামী বিজ্ঞানানন্দ। অবশ্য স্বামী বিবেকানন্দ আগেই নিজের পরিকল্পনা জানিয়ে দিয়েছিলেন। আর সেই পরিকল্পনা মেনেই নকশা তৈরি করা হয়েছিল। প্রতিবছর দুর্গাপূজার সময় হাজার হাজার মানুষ বেলুড় মঠের কুমারী পুজো দেখতে ভিড় জমান।

২. হাওড়া সেতু :-

হাওড়া সেতুর অপর নাম রবীন্দ্র সেতু। এটি হুগলি নদীর উপর অবস্থিত। কলকাতা আর হাওড়ার মাঝে সংযোগ স্থাপন করেছে এই সেতুটি।

এছাড়াও রয়েছে – আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ভারতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, বিদ্যাসাগর সেতু, বিবেকানন্দ ও নিবেদিতা সেতু, গাদিয়াপাড়া আর গড়চুমুক।

হাওড়া জেলার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা 

এই জেলায় ৩৩ টি সরকারি হাসপাতাল, ৮৯ টি ক্লিনিক, ৪৪ টি ডিসপেন্সারি আর ৫২ টি স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে। এখানে রয়েছে হাওড়া জেলা হাসপাতাল।

হাওড়া জেলার  শিক্ষা ব্যবস্থা 

হাওড়া জেলায় একাধিক শিক্ষা কেন্দ্র রয়েছে। তুমি বেশিরভাগ কলেজে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত। এই জেলায় রয়েছে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সাইন্স ইউনিভার্সিটি। আর বেলুড়ে রয়েছে রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়।

হাওড়া জেলার  পরিবহন ব্যবস্থা 

হাওড়া জেলায় উন্নত সড়ক পথ, রেলপথ ও মেট্রো পথের সু-বন্দোবস্ত রয়েছে। এই জেলার মধ্য দিয়ে ২ নং জাতীয় সড়ক, ৫ নং জাতীয় সড়ক, ৬ নং জাতীয় সড়ক প্রসারিত হয়েছে। এছাড়া রয়েছে ২৭৯ কিলোমিটার দীর্ঘ জেলা সড়ক আর ১৮৩ কিলোমিটার দীর্ঘ গ্রামীণ সড়ক। এখানকার নিকটবর্তী বিমানবন্দর হলো নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।

হাওড়া জেলার উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি

এই জেলার সাথে সম্পর্কযুক্ত কয়েকজন প্রখ্যাত ব্যক্তি হলেন –

১. শৈলেন ঘোষ
২. বিহারীলাল সরকার
৩. রায়গুণাকার ভারতচন্দ্র রায়
৪. ভবানীপ্রসাদ মজুমদার
৫. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়
৬. কৈলাস চন্দ্র বিদ্যাভূষণ
৭. তারাপদ সাঁতরা প্রমূখ।

হাওড়া জেলার প্রশাসনিক ব্যবস্থা

হাওড়া জেলায় ২ টি মহকুমা রয়েছে। যথা :- হাওড়া সদর মহকুমা ও উলুবেরিয়া মহকুমা। এই জেলায় রয়েছে ১১ টি থানা। এই জেলায় রয়েছে মাত্র ১ টি পৌর সংস্থা আর ১ টি পৌরসভা। হাওড়া জেলায় মোট ১৪ টি ব্লক রয়েছে। যেমন :-
১. শ্যামপুর ১
২. শ্যামপুর ২
৩. উদয়নারায়নপুর
৪. সাঁকরাইল
৫. পাঁচলা
৬. ডোমজুড়
৭. বালি জগাছা
৮. জগৎবল্লভপুর
৯. আমতা ১
১০. আমতা ২
১১. বাগনান ১
১২. বাগনান ২
১৩. উলুবেরিয়া ১
১৪. উলুবেরিয়া ২।

হাওড়া জেলা‌ কিসের জন্য বিখ্যাত ?

উঃ হাওড়া জেলা রবীন্দ্র সেতু, বেলুড় মঠ ইত্যাদির জন্য বিখ্যাত।

হাওড়া জেলায় কয়টি ব্লক রয়েছে ?

উঃ হাওড়া জেলায় মোট ১৪ টি ব্লক রয়েছে। যেমন :-
১. শ্যামপুর ১
২. শ্যামপুর ২
৩. উদয়নারায়নপুর
৪. সাঁকরাইল
৫. পাঁচলা
৬. ডোমজুড়
৭. বালি জগাছা
৮. জগৎবল্লভপুর
৯. আমতা ১
১০. আমতা ২
১১. বাগনান ১
১২. বাগনান ২
১৩. উলুবেরিয়া ১
১৪. উলুবেরিয়া ২।

হাওড়া জেলার মহকুমা কয়টি ?

উঃ হাওড়া জেলায় ২ টি মহকুমা রয়েছে। যথা :- হাওড়া সদর মহকুমা ও উলুবেরিয়া মহকুমা।

হাওড়া জেলায় কয়টি থানা আছে ?

উঃ হাওড়া জেলায় রয়েছে ১১ টি থানা।

হাওড়া জেলার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে লেখ।

উঃ এই জেলায় ৩৩ টি সরকারি হাসপাতাল, ৮৯ টি ক্লিনিক, ৪৪ টি ডিসপেন্সারি আর ৫২ টি স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে। এখানে রয়েছে হাওড়া জেলা হাসপাতাল।

হাওড়া জেলার প্রধান নদী কোনটি ?

উঃ এই জেলার প্রধান নদী হল হুগলি।

হাওড়া জেলার পাহাড়ের নাম লেখ।

উঃ এই জেলায় কোন পাহাড় নেই।

হাওড়া জেলার পৌরসভা কয়টি ?

উঃ হাওড়া জেলায় মাত্র ১ টি পৌরসভা রয়েছে ।

উপসংহার

এটি পশ্চিমবঙ্গের প্রেসিডেন্সি বিভাগের অন্তর্গত একটি জেলা। এই জেলার সদর শহর হল হাওড়া। আয়তনের নিরিখে হাওড়া জেলার আয়তন পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে অষ্টাদশ তম। ১৯৩৭ সালে হাওড়া জেলা স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আর ১৯৬৩ সালে হাওড়া জেলা প্রেসিডেন্সি বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হয়।

এই জেলার মধ্য দিয়ে ২ নং জাতীয় সড়ক, ৫ নং জাতীয় সড়ক, ৬ নং জাতীয় সড়ক প্রসারিত হয়েছে। হাওড়া জেলা দক্ষিণে ২২° ১২’ উত্তর অক্ষাংশ থেকে উত্তরে ২২° ৪৮’ উত্তর অক্ষাংশ পর্যন্ত ও পশ্চিমে ৮৭° ৫০’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ থেকে পূর্বে ৮৮° ২৩’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত অবস্থিত। এই জেলার পূর্ব প্রান্তে হুগলি নদী প্রবাহিত হয়। আর পশ্চিম প্রান্তে প্রবাহিত হয় রূপনারায়ণ।

Leave a Comment