বাঁকুড়া জেলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ

পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলির মধ্যে থেকে অন্যতম হল বাঁকুড়া। এটি মেদিনীপুর বিভাগের অন্তর্গত। এই জেলার উত্তর-পূর্ব দিকে রয়েছে বর্ধমান আর পশ্চিম বর্ধমান জেলা। দক্ষিণ দিকে রয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা আর পশ্চিম দিকে রয়েছে পুরুলিয়া জেলা।

দক্ষিণ-পূর্ব দিকে রয়েছে হুগলি জেলা। দামোদর নদ বাঁকুড়া আর বর্ধমান জেলার মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে। বাঁকুড়া জেলা হল মধ্যযুগীয় পশ্চিমবঙ্গের মল্ল রাজাদের কেন্দ্রভূমি। বাঁকুড়া জেলার সদর শহর হল বাঁকুড়া।

বাঁকুড়া জেলার ইতিহাস

খ্রিস্টপূর্ব ১ হাজার অব্দে দ্বারকেশ্বর নদীর উত্তর তীরে তাম্র প্রস্তর যুগে প্রথম জনবসতি গড়ে ওঠে। এই জেলার আদিবাসীরা ছিল প্রোটো অস্ট্রোলয়েড আর প্রোটো দ্রাবিড়ীয় জনগোষ্ঠীর মানুষ। পরবর্তী সময়ে এই অঞ্চলে আর্য জাতির মানুষেরাও এসে বসবাস শুরু করে। বাঁকুড়া জেলার ডিহরে প্রাচীন জনবসতির নিদর্শন পাওয়া গেছে। এক সময় এই জেলা ছিল রাঢ় অঞ্চলের অন্তর্গত।

এই অঞ্চলের অধিবাসীদের অসুর মনে করা হত। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে পুষ্করনার রাজা ছিলেন সিংহ বর্মনের পুত্র চন্দ্র বর্মন। চন্দ্র বর্মন কে পরাজিত করেছিলেন রাজা সমুদ্র গুপ্ত। এরপর বাঁকুড়া জেলা ও তার আশেপাশে গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাজত্ব শুরু হয়। বহু বছর বাঁকুড়া জেলা দন্ডভুক্তি আর বর্ধমান ভুক্তি রাজ্যের অধীনস্থ ছিল।

ব্রিটিশ শাসনের আগে পর্যন্ত বিষ্ণুপুরের হিন্দু রাজারা বাঁকুড়া জেলায় প্রায় ১ হাজার বছর রাজত্ব করেছিলেন। সেই সময় বিষ্ণুপুর ও তার আশেপাশে এলাকা মল্লভূম নামে পরিচিত ছিল। মল্ল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আদি মল্ল। তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র জয় মল্ল সিংহাসনে বসেছিলেন। এরপর ১৮৫৬ সাল নাগাদ বিষ্ণুপুরের সিংহাসনে বসেছিলেন শাসক বীর হাম্বির।

শ্রীনিবাস আচার্যের কাছে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন তিনি। তারপর থেকেই বিষ্ণুপুরে মদনমোহনের পুজো শুরু হয়। ১৭৬০ সালে বর্ধমান জেলার সাথে আংশিকভাবে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক্তিয়ারভুক্ত হয় এই জেলা। ১৮৭৯ সালে এই অংশ পশ্চিম বর্ধমানের সাথে যুক্ত হয়। আর ১৮৮১ সালে এই গোটা অংশের নাম হয় বাঁকুড়া জেলা।

বাঁকুড়া জেলার অবস্থান

এই জেলার উত্তর-পূর্ব দিকে রয়েছে বর্ধমান আর পশ্চিম বর্ধমান জেলা। দক্ষিণ দিকে রয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা আর পশ্চিম দিকে রয়েছে পুরুলিয়া জেলা। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে রয়েছে হুগলি জেলা। দামোদর নদ বাঁকুড়া আর বর্ধমান জেলার মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে।

বাঁকুড়া জেলার জনসংখ্যা

২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী বাঁকুড়া জেলার মোট জনসংখ্যা ৩৫ লাখ ৯৬ হাজার ৬৭৪ জন। এর মধ্যে থেকে পুরুষের সংখ্যা হল ১৮ লাখ ৩৮ হাজার ৯৫ জন আর মহিলার সংখ্যা হল ১৭ লাখ ৫৮ হাজার ৫৭৯ জন। লিঙ্গানুপাত হল ১০০০ : ৯৫৪ (পুরুষ : মহিলা)। এই জেলার ৯১.৭০ শতাংশ মানুষ অর্থাৎ ৩২ লাখ ৯৬ হাজার ৬০১ জন গ্রামে বসবাস করেন।

আর বাকি ৮.৩০ শতাংশ মানুষ অর্থাৎ ২ লাখ ৯৯ হাজার ৭৭৩ জন পৌর অঞ্চলে বসবাস করেন। গ্রামের ১৫ লাখ ১৫ হাজার ৪৫০ জন হলেন পুরুষ। আর বাদবাকি ১৪ লাখ ৪১ হাজার ৯৯৭ জন বাসিন্দা হলেন মহিলা। অপরদিকে পৌর এলাকার ১ লাখ ২০ হাজার ৫৫২ জন‌ হলেন পুরুষ ও ১ লাখ ১৪ হাজার ৯৯৭ জন মহিলা।

বাঁকুড়া জেলার জলবায়ু

এই জেলার অধিকাংশ মাটি ল্যাটেরাইট ও পলি মৃত্তিকা। এই জেলার আবহাওয়া উষ্ণ ও শুষ্ক প্রকৃতির। তবে এখানকার জলবায়ু দূষণমুক্ত। গ্রীষ্মকালে এখানকার সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা থাকে প্রায় ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে। আর সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা থাকে ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে।

অপরদিকে শীতকালে এই জেলার সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা থাকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা থাকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে। এখানকার বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১ হাজার ৪০০ মিলিমিটার।

বাঁকুড়া জেলার নদ-নদী

দামোদর নদ বাঁকুড়া আর বর্ধমান জেলার মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে। এই জেলায় একাধিক নদ-নদী রয়েছে। তবে এখানকার প্রধান নদ-নদী হল দারোকেশ্বর কংসাবতী, শিলাই ও দামোদর।

বাঁকুড়া জেলার বনাঞ্চল

বাঁকুড়া জেলার মোট আয়তনের ২৪৭.৭০ হাজার হেক্টর জমি অর্থাৎ ২১.৪৭ শতাংশ জমি হল বনাঞ্চল। এই বনভূমিতে রয়েছে শালবন। এছাড়াও রয়েছে সেগুন, পলাশ, বাবলা, আম, মহুয়া, কুসুম, কাঁঠাল, বহেড়া ইত্যাদি গাছ।

বাঁকুড়া জেলার দর্শনীয় স্থান

বাঁকুড়া জেলায় বেশকিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে। যেমন –

১. বিষ্ণুপুর :- এটি বাঁকুড়া জেলার একটি শহর। এখানে রয়েছে বিভিন্ন স্থাপত্য, সংস্কৃতি আর পোড়ামাটির কারুকার্য। মদনমোহন মন্দির, রসমঞ্চ, শ্যাম রায় মন্দির প্রভৃতি এখানকার বিখ্যাত সব জায়গা।

২. মুকুট মণিপুর :- এখানে দূর দূরান্ত থেকে পর্যটকরা ঘুরতে আসেন‌। সবুজ বন আর নীল জলাশয় এখানকার বিশেষত্ব। এখানে রয়েছে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম মাটির বাঁধ। এই বাঁধ পুরো মুকুটের মতো দেখতে।

এছাড়াও এই জেলায় রয়েছে –

শুশুনিয়া পাহাড়, জয়রামবাটি, বিহারিনাথ মন্দির প্রভৃতি।

বাঁকুড়া জেলার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা

এই জেলায় ৮৭ টি স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে ৫০৮ টি ক্লিনিক ও ৪২ টি ডিসপেনসারি। আর ৫ টি হাসপাতাল আছে।

বাঁকুড়া জেলার শিক্ষা ব্যবস্থা

এই জেলার মোট সাক্ষরতা ৭০.৭৬ শতাংশ। বাঁকুড়ার মোট জনসংখ্যার ৭০.২৬ শতাংশ পুরুষ শিক্ষিত আর মোট জনসংখ্যার ৮০.০৫ শতাংশ নারী শিক্ষিত। গ্রামের ৬২.০৯; শতাংশ মানুষ শিক্ষিত এবং পৌর এলাকার ৮৪.৪২ শতাংশ মানুষ শিক্ষিত। এই জেলায় নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয় থেকে শুরু করে মেডিকেল কলেজ সবই রয়েছে। এখানকার কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হল –

১. সোনামুখী কলেজ
২. পাঁচমুড়া মহাবিদ্যালয়
৩. বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়
৪. বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিকেল কলেজ ইত্যাদি।

বাঁকুড়া জেলার পরিবহন ব্যবস্থা

এই জেলায় সড়ক পথের পাশাপাশি রেলপথেরও সুবিধা রয়েছে। এখানকার কয়েকটি রেলস্টেশন হল – পাত্রসায়ের, বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর, ওন্দা ও সোনামুখ। এই জেলার মোট সড়ক পথ ১ হাজার ১৮৬ কিলোমিটার। জাতীয় সড়ক ১২৬ কিলোমিটার আর রাজ্য সড়ক ৩৫৫ কিলোমিটার। এছাড়াও দ্বারকেশ্বর, কংসাবতী সহ বিভিন্ন নদীতে রয়েছে ফেরি চলাচলের সুবিধা।

বাঁকুড়া জেলার উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি

এই জেলার কয়েকজন প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব হলেন –

১. রামকিঙ্কর বেইজ
২. ননীবালা গুহ
৩. রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়
৪. কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।

বাঁকুড়া জেলার প্রশাসনিক ব্যবস্থা

এই জেলার সদর শহর বাঁকুড়া। বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া সদর ও খাতড়া সহ মোট ৩ টি মহকুমা রয়েছে এই জেলায়। এছাড়াও রয়েছে ৩ টি পৌরসভা। যথা :- বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া ও সোনামুখী। এই জেলায় রয়েছে ১২ টি শহর, ২২ টি পঞ্চায়েত সমিতি, ১৯০ টি গ্রাম পঞ্চায়েত, ২২ টি ব্লক ও ২৩ টি থানা। আরও রয়েছে ৩ হাজার ৮২৩ টি মৌজা ও ৫ হাজার ১৮৭ টি গ্রাম সংসদ‌। এই জেলায় ১২ টি বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে। ২ টি লোকসভা কেন্দ্র রয়েছে। যথা :- বিষ্ণুপুর ও বাঁকুড়া লোকসভা। ১ টি জেলা পরিষদ দেখি পড়ে গেছে।

বাঁকুড়া জেলার প্রশ্ন উত্তর

বাঁকুড়া কিসের জন্য বিখ্যাত ?

উঃ বাঁকুড়া জেলা টেরাকোটার জন্য বিখ্যাত।

বাঁকুড়া জেলায় কয়টি ব্লক রয়েছে ?

উঃ এই জেলায় রয়েছে ২২ টি ব্লক।

বাঁকুড়া জেলার মহকুমা কয়টি ?

উঃ বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া সদর ও খাতড়া সহ মোট ৩ টি মহকুমা রয়েছে এই জেলায়।

বাঁকুড়া জেলায় কয়টি থানা আছে ?

উঃ বাঁকুড়া জেলায় ২৩ টি থানা রয়েছে।

বাঁকুড়া জেলার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে লেখ।

উঃ এই জেলায় ৮৭ টি স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে ৫০৮ টি ক্লিনিক ও ৪২ টি ডিসপেনসারি। আর ৫ টি হাসপাতাল আছে।

বাঁকুড়া জেলার প্রধান নদী কোনটি ?

উঃ এখানকার প্রধান নদ-নদী হল দারোকেশ্বর কংসাবতী, শিলাই ও দামোদর।

বাঁকুড়া জেলার পাহাড়ের নাম লেখ।

উঃ একাকার পাহাড় হল‌ শুশুনিয়া পাহাড় আর বিহারিনাথ পাহাড়।

বাঁকুড়া জেলার পৌরসভা কয়টি ?

উঃ বাঁকুড়া জেলায় রয়েছে ৩ টি পৌরসভা। যথা :- বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া ও সোনামুখী।

উপসংহার

পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলির মধ্যে থেকে অন্যতম হল বাঁকুড়া। এটি মেদিনীপুর বিভাগের অন্তর্গত। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী বাঁকুড়া জেলার মোট জনসংখ্যা ৩৫ লাখ ৯৬ হাজার ৬৭৪ জন। এই জেলার উত্তর-পূর্ব দিকে রয়েছে বর্ধমান আর পশ্চিম বর্ধমান জেলা।

দক্ষিণ দিকে রয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা আর পশ্চিম দিকে রয়েছে পুরুলিয়া জেলা। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে রয়েছে হুগলি জেলা। দামোদর নদ বাঁকুড়া আর বর্ধমান জেলার মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে। এই জেলার অধিকাংশ মাটি ল্যাটেরাইট ও পলি মৃত্তিকা। এই জেলার আবহাওয়া উষ্ণ ও শুষ্ক প্রকৃতির। তবে এখানকার জলবায়ু দূষণমুক্ত।

Leave a Comment