পূর্ব বর্ধমান জেলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ

পূর্ব বর্ধমান জেলা আগে বর্ধমানের অংশ ছিল। ২০১৭ সালের ৭ ই এপ্রিল বর্ধমান জেলা বিভক্ত হয়ে পূর্ব বর্ধমান আর পশ্চিম বর্ধমান গঠিত হয়। বর্ধমান এই জেলার প্রধান শহর আর প্রশাসনিক সদর দপ্তর। বর্ধমান নামের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন মতামত শুনতে পাওয়া যায়‌‌।

বর্ধমান কথার অর্থ ‘যে স্থানে সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়’। এছাড়াও বলা হয় গঙ্গা উপত্যকা থেকে আর্জানাইজেশন এর অগ্রগতিতে সীমান্ত উপনিবেশ এর বৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি হয়েছিল। এই প্রতীককেই বর্ধমান বলা হত। তবে এই জৈনদের কল্পসূত্র অনুযায়ী মহাবীর জৈন বর্ধমানের অষ্টিকগ্রামে কিছু সময় কাটিয়েছিলেন। আগে তাঁর নাম ছিল বর্ধমান। সেই থেকেই এই অঞ্চলের নাম হয়েছে বর্ধমান। পরে বর্ধমান বিভক্ত হয়ে গিয়ে পূর্ব বর্ধমান ও পশ্চিম বর্ধমান আত্মপ্রকাশ করে।

পূর্ব বর্ধমান জেলার ইতিহাস

১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস প্রশাসনিক কাজে সুবিধার জন্য বর্ধমান -কে জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। এরপর ২০১৭ সালের ৭ ই এপ্রিল বর্ধমান জেলার বিভক্ত হয়ে যায়। আর গঠিত হয় পূর্ব বর্ধমান ও পশ্চিম বর্ধমান জেলা। বর্ধমান জেলার পূর্ব অংশই হল পূর্ব বর্ধমান।

পূর্ব বর্ধমান জেলার অবস্থান

পূর্ব বর্ধমান জেলার উত্তর দিকে রয়েছে বীরভূম জেলা ও মুর্শিদাবাদ জেলা। আর দক্ষিণ দিকে রয়েছে হুগলি জেলা। পূর্ব দিকে রয়েছে নদীয়া জেলা। আর পশ্চিম দিকে রয়েছে যথাক্রমে বাঁকুড়া ও পশ্চিম বর্ধমান জেলা।

এই জেলা ২৩° ৫৩’ উত্তর থেকে ২২° ৫৬’ উত্তর অক্ষাংশ ও ৮৮° ২৫’ পূর্ব থেকে ৮৭° ৫৬’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। এই জেলায় আয়তন ৫৪৩২.৬৯ বর্গ কিলোমিটার। এটি দামোদর নদের তীরে অবস্থিত। ২৩° ১৪’ উত্তর অক্ষাংশ আর ৮৭° ৫১’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে এই জেলার অবস্থান।

পূর্ব বর্ধমান জেলার জনসংখ্যা

২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী পূর্ব বর্ধমান জেলার মোট জনসংখ্যা ৪৮ লাখ ৩৫ হাজার ৫৩২ জন।‌ জনসংখ্যার মোট ৫২.০৭ শতাংশ মানুষ হলেন পুরুষ আর বাকি ৪৮.৯৩ শতাংশ হলেন মহিলা। এই জেলার বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে বসবাস করেন।

প্রায় ৮৪.৯৮ শতাংশ মানুষের বসবাস গ্রামাঞ্চলে। আর বাকি ১৫.০২ শতাংশ মানুষ বাস করেন মফস্বলে। এছাড়াও এই জেলার প্রায় ৫৯.৬৪ শতাংশ মানুষ কর্মহীন। আর ৪০.৩৬ শতাংশ মানুষ কাজ করেন। এই জেলার লিঙ্গ অনুপাত ৯৫৮ : ১০০০ (মহিলা : পুরুষ)।

পূর্ব বর্ধমান জেলার ভূপ্রকৃতি

এই জেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়। এই জেলার ভূমি সমতল। এটি পলল সমভূমি অঞ্চল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই পলল সমভূমি ৪ টি টপোগ্রাফিক অঞ্চলে বিভক্ত। এই জেলায় প্রচুর জলাশয় রয়েছে। আপনারা জায়গায় জায়গায় পুষ্করিনি, ছোটখাটো খাল ও বিল দেখতে পাবেন।

পূর্ব বর্ধমান জেলার জলবায়ু

এই জেলায় গ্রীষ্মের দাবদাহ বেশি। এছাড়াও আবহাওয়া আর্দ্র। এই জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর আশেপাশে আর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস এর আশেপাশে। বছরের অন্যান্য সময় অল্প বিস্তার বৃষ্টিপাত হলেও। এই জেলায় সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত বর্ষাকালেই হয়। এই জেলার বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১ হাজার ৩৪৭ মিলিমিটার।

পূর্ব বর্ধমান জেলার নদ-নদী

পূর্ব বর্ধমান জেলায় বেশ কিছু নদনদী প্রবাহিত হয়। যেমন- দামোদর, ভাগীরথী, বেহুলা গাঙ্গুর, অজয়, ব্রাহ্মণী সিঙ্গারাম ইত্যাদি। এই জেলা দামোদর নদের তীরে অবস্থিত।

পূর্ব বর্ধমান জেলার ভাষা

এই জেলায় বসবাসকারী বেশিরভাগ মানুষই বাংলা ভাষায় কথা বলেন। বাংলা ভাষায় কথা বলা মানুষের হার এখানে ৯২.৮৬ শতাংশ। এছাড়াও রয়েছে হিন্দি, সাঁওতালি সহ অন্যান্য ভাষাভাষীর মানুষেরা। এই জেলায় ১.৬৬ শতাংশ মানুষের ভাষা হিন্দি। আর ৫.০৩ শতাংশ মানুষের ভাষা সাঁওতালি।

পূর্ব বর্ধমান জেলার দর্শনীয় স্থান

এই যে লাইভ বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে। যেমন-

১. সর্বমঙ্গলা মন্দির :- এই মন্দির ১৭০২ সালে মহারাজা কীর্তিচাঁদ স্থাপন করেছিলেন। এই মন্দিরের দেবী হলেন মাতা সর্বমঙ্গলা। এটি অবিভক্ত বাংলার প্রথম নবরত্ন মন্দির।

২. শের আফগানের সমাধি :- এটি রাজবাড়ীর কাছে অবস্থিত।

৩. অট্টহাস সতীপীঠ মন্দির :- এটি ৫১ সতী পীঠের মধ্যে থেকে অন্যতম। এখানে মাতা সতীর অধঃ ওষ্ঠ পতিত হয়েছিল।

৪. ১০৮ শিব মন্দির :- ১৭৭৮ সালে মহারাজা তিলক চন্দনের স্ত্রী মহারানী বিষ্নান কুমারী এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। এই মন্দির দর্শন করতে দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটকরা পূর্ব বর্ধমানে যায়।

এছাড়াও এই জেলায় রয়েছে-
৫. নব কৈলাস মন্দির
৬. মাধাইতলা আশ্রম
৭. কপিল মুনি আশ্রম
৮. শ্রী গৌরাঙ্গ মন্দির
৯. চুপি পাখিরালয়
১০. দুর্গাদাস লাহিড়ীর ভিটে
১১. লর্ড কার্জন গেট
১২. ঝুলন্ত রেলওয়ে ব্রিজ ইত্যাদি।

পূর্ব বর্ধমান জেলার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা

এই জেলায় বেশ কিছু স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। যেমন- ড্রিম লাইফ হসপিটাল, বর্ধমান মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটাল, চাঁদপুর হাসপাতাল, সুপার স্পেশালিটি উইং হসপিটাল ইত্যাদি।

পূর্ব বর্ধমান জেলার শিক্ষা ব্যবস্থা

পূর্ব বর্ধমানের সাক্ষরতার হার ৭৫.৪৮ শতাংশ। এই জেলার মোট জনসংখ্যার ৮১.২৭ শতাংশ পুরুষ শিক্ষিত আর ৬৯.৪৩ শতাংশ মহিলা শিক্ষিত। এই জেলায় বেশ কিছু স্কুল ও কলেজ রয়েছে। যেমন- কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়, বর্ধমান টাউন স্কুল, বর্ধমান সি এম এস উচ্চ বিদ্যালয়, তারাপদ দে এডুকেশনাল ইনস্টিটিউট, প্রশান্ত দাশগুপ্ত কলেজ অফ এডুকেশন, কাটোয়া কলেজ, গুসকরা মহাবিদ্যালয়, বর্ধমান রাজ কলেজ, বর্ধমান মেডিকেল কলেজ, চন্দ্রপুর কলেজ, কালনা কলেজ, মেমারি কলেজ, বিবেকানন্দ মহাবিদ্যালয় ইত্যাদি।

পূর্ব বর্ধমান জেলার পরিবহন ব্যবস্থা

এই জেলায় উন্নত সড়ক পথ রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে রেলপথে যাতায়াতের সুবন্দোবস্ত। এই জেলার কয়েকটি রেল স্টেশন হল- মেমারি রেলস্টেশন, কালনা রেলস্টেশন, বর্ধমান জংশন, কাটোয়া জংশন, গুসকরা রেলস্টেশন, পাটুলি রেলস্টেশন, পূর্বস্থলী রেল স্টেশন, সমুদ্রগড় রেলস্টেশন ইত্যাদি।

পূর্ব বর্ধমান জেলার উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি

এই জেলার প্রখ্যাত ব্যক্তিবর্গ হলেন-

১. ড. সুকুমার সেন :- তিনি একজন বাঙালি ভাষাবিদ ছিলেন।

২. রাসবিহারী বসু :- তিনি ছিলেন একজন ভারতীয় বিপ্লবী নেতা।

৩. অক্ষয় কুমার দত্ত :- তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক ও লেখক।

৪. সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত :- তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত বাঙালি কবি। তাঁকে ছন্দের জাদুকর বলা হয়।

৫. কমলাকান্ত ভট্টাচার্য :- তিনি ছিলেন একজন সাধক সার্থ কবি ও যোগী।

৬. হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় :- তিনি ছিলেন একজন ভারতীয় সাংবাদিক।

৭. বটুকেশ্বর দত্ত :- তিনি ছিলেন একজন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী।

এছাড়াও কয়েকজন প্রখ্যাত ব্যক্তিবর্গ হলেন- মালাধর বসু, ঘনরাম চক্রবর্তী, বিনয় চৌধুরী, সুবোধ চৌধুরী ও দুলাল তর্কবাগীশ প্রমূখ।

পূর্ব বর্ধমান জেলার প্রশাসনিক ব্যবস্থা

এই জেলার সদর শহর হল বর্ধমান। পূর্ব বর্ধমান জেলায় ৪ টি মহকুমা রয়েছে। যথা :- কাটোয়া, কালনা, বর্ধমান সদর উত্তর ও বর্ধমান সদর দক্ষিণ। এই জেলায় মোট ৬ টি পৌরসভা রয়েছে। যেগুলি হল- কাটোয়া, দাঁইহাট, বর্ধমান, মেমারি, কালনা ও গুসকরা।

এই জেলায় জামালপুর, মেমারি ১, মেমারি ২ ও মন্টেশ্বর সহ মোট ২৩ টি ব্লক রয়েছে। এছাড়াও থানা রয়েছে ১৮ টি। ২০ টি সেন্সাস টাউন, ২৩ টি পঞ্চায়েত সমিতি ও ২১৫ টি গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে এই জেলায়। পূর্ব বর্ধমানে ২ হাজার ১০২ টি গ্রাম রয়েছে। আর ডাকঘর রয়েছে ৭৭০ টি। এই জেলায় ৪ টি লোকসভা কেন্দ্র রয়েছে আর ১৬ টি বিধানসভা কেন্দ্র। এই জেলায় ১ টি জেলা পরিষদ রয়েছে।

পূর্ব বর্ধমান জেলার কৃষিকাজ

এই জেলার প্রধান জীবিকা হল কৃষিকাজ। পূর্ব বর্ধমান জেলার মাটি থেকে জলবায়ু সবই ফসল উৎপাদনের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। সবথেকে বেশি ধান চাষ এখানেই হয়। এছাড়াও গম, ভুট্টা ও আলু সহ বিভিন্ন ধরনের ফলমূল ও তৈলবীজ উৎপাদন করা হয় এই জেলায়। অবিভক্ত বর্ধমান জেলা ধান উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম স্থানে ছিল। বর্তমানে পূর্ব বর্ধমানে সব থেকে বেশি ধান উৎপাদন হয়।

পূর্ব বর্ধমান জেলার প্রশ্ন উত্তর

পূর্ব বর্ধমান কিসের জন্য বিখ্যাত ?

পূর্ব বর্ধমান জেলা ধান চাষের জন্য বিখ্যাত।

পূর্ব বর্ধমান জেলায় কয়টি ব্লক রয়েছে ?

পূর্ব বর্ধমান জেলায় মোট ২৩ টি ব্লক রয়েছে।

পূর্ব বর্ধমান জেলার মহকুমা কয়টি ?

পূর্ব বর্ধমান জেলায় ৪ টি মহকুমা রয়েছে। যথাক্রমে – বর্ধমান সদর উত্তর, বর্ধমান সদর দক্ষিণ, কালনা ও কাটোয়া।

পূর্ব বর্ধমান জেলায় কয়টি থানা আছে ?

পূর্ব বর্ধমান জেলায় মোট ১৮ টি থানা রয়েছে।

পূর্ব বর্ধমান জেলার প্রধান নদী কী ?

পূর্ব বর্ধমান জেলার প্রধান নদী হল ভাগীরথী। আর প্রধান নদ হল দামোদর।

পূর্ব বর্ধমান জেলার প্রধান ভাষা কী ?

পূর্ব বর্ধমান জেলার প্রধান ভাষা হল বাংলা।

পূর্ব বর্ধমান জেলার পৌরসভা কয়টি ?

এই জেলায় মোট ৬ টি পৌরসভা রয়েছে। যেগুলি হল- কাটোয়া, দাঁইহাট, বর্ধমান, মেমারি, কালনা ও গুসকরা।

উপসংহার

পূর্ব বর্ধমান জেলা আগে বর্ধমানের অংশ ছিল। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস প্রশাসনিক কাজে সুবিধার জন্য বর্ধমান -কে জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ২০১৭ সালের ৭ ই এপ্রিল বর্ধমান জেলা বিভক্ত হয়ে পূর্ব বর্ধমান আর পশ্চিম বর্ধমান গঠিত হয়। বর্ধমান কথার অর্থ যে স্থানে সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়। এই জেলা ২৩° ৫৩’ উত্তর থেকে ২২° ৫৬’ উত্তর অক্ষাংশ ও ৮৮° ২৫’ পূর্ব থেকে ৮৭° ৫৬’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত।

এই জেলায় আয়তন ৫৪৩২.৬৯ বর্গ কিলোমিটার। পূর্ব বর্ধমানের সাক্ষরতার হার ৭৫.৪৮ শতাংশ। এই জেলার মোট জনসংখ্যার ৮১.২৭ শতাংশ পুরুষ শিক্ষিত আর ৬৯.৪৩ শতাংশ মহিলা শিক্ষিত। এই জেলার প্রধান জীবিকা হল কৃষিকাজ। পূর্ব বর্ধমান জেলার মাটি থেকে জলবায়ু সবই কৃষিকাজের পক্ষে বিশেষভাবে উপযোগী।

এখানেই সবথেকে বেশি ধান চাষ হয়। এই জেলার বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে বসবাস করেন। প্রায় ৮৪.৯৮ শতাংশ মানুষের বসবাস গ্রামাঞ্চলে। পূর্ব বর্ধমানে ২ হাজার ১০২ টি গ্রাম রয়েছে। এই ধরনের আরও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটটি ফলো করতে পারেন‌। আজকের প্রতিবেদনটি সম্পূর্ণ পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

Leave a Comment