পশ্চিম বর্ধমান জেলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ

পশ্চিম বর্ধমান হল বর্ধমান বিভাগের একটি জেলা। এই জেলার সদর শহর হল আসানসোল। এই জেলায় কয়লা উত্তোলন হয়। এছাড়াও শিল্পের দিক থেকে এই জেলা বেশ খানিকটা এগিয়ে। ২০১৭ সালের ৭ ই এপ্রিল এই জেলা আনুষ্ঠানিক ভাবে চালু হয়েছিল।

আসানসোল ও দুর্গাপুর মহকুমা নিয়ে গঠিত হয়েছে এই জেলা। এই জেলা ২৬° ৩৮’ উত্তর অক্ষাংশ ও ৮৬° ৯৮’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। এই জেলাকে ঘিরে বেশ কিছু ঐতিহাসিক কাহিনী শোনা যায়। সেই সম্পর্কেই আজ আপনারা জানতে পারবেন।

পশ্চিম বর্ধমান জেলার ইতিহাস

বর্ধমান জেলার উল্লেখ পাওয়া যায় ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে। ১৮৬৯ সালে ঔরঙ্গজেবের আদেশ অনুযায়ী বর্ধমান রাজ পরিবারের রাজা কৃষ্ণ রাম রায় বর্ধমানের জমিদার হয়েছিলেন। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্য বেশ কিছুটা দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় বাংলার নবাব হন মুর্শিদ কুলি খাঁ। এর আগে বর্ধমান পূর্ববর্তী পরগনা ছিল। কিন্তু মুর্শিদ কুলি খাঁ সেটিকে চাকলা হিসেবে চিহ্নিত করেন।

এরপর বাংলার সিংহাসনে বসেন মুঘল সম্রাট আলিবর্দী খাঁ। এই সময় বর্গিরা বর্ধমানে আক্রমণ করে। আর সমস্ত ধন সম্পদ লুণ্ঠন করে। তারপর ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ব্রিটিশরা জয় লাভ করে। সেই যুদ্ধে বর্ধমান জেলা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে যায়। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বর্ধমানের সাথে বাঁকুড়া, হুগলি ও বীরভূমের তৃতীয়াংশ যুক্ত করে।

১৮০৫ সালে শেরগড়, সেনপাহাড়ীর পশ্চিম পরগনা ও বাঁকুড়ার কিছু অংশ মিলে গঠিত হয় জঙ্গল মহল। এটি ছিল নতুন একটি জেলা। আবার বাঁকুড়া -কে পরে আলাদা জেলা ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই সময় শেরগড় আর সেনপাহাড়ি পুনরায় বর্ধমানের সাথে যুক্ত হয়। ১৮২০ সালে অবশ্য হুগলি বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল।

আর ১৮৩৭ সাল নাগাদ বাঁকুড়া ও বীরভূম বিভক্ত হয়ে যায়। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ ক্রাউন সমগ্র দেশের প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯০৬ সালে রানীগঞ্জ মহকুমা হয়ে যায় আসানসোল মহকুমা। আর পরগনা রূপান্তরিত হয়ে যায় থানায়। ১৯৬৮ সালে আসানসোল মহাকুমা থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল দুর্গাপুর মহকুমা। আর ২০১৭ সালের ৭ ই এপ্রিল সমগ্র বর্ধমান জেলা ২ ভাগে বিভক্ত হয়ে নতুন ২ টি জেলা গঠিত হয়। বর্ধমান জেলার পশ্চিম ভাগই হল পশ্চিম বর্ধমান।

পশ্চিম বর্ধমান জেলার অবস্থান

পশ্চিমবঙ্গের ২৩ টি জেলার মধ্যে থেকে অন্যতম হল পশ্চিম বর্ধমান জেলা। এই জেলার সদর শহর হল আসানসোল। এই জেলা ২৬° ৩৮’ উত্তর অক্ষাংশ ও ৮৬° ৯৮’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত।

এই জেলার উত্তর দিকে রয়েছে বীরভূম জেলা আর দক্ষিণ দিকে রয়েছে যথাক্রমে পুরুলিয়া জেলা ও বাঁকুড়া জেলা। আবার পূর্ব দিকে রয়েছে পূর্ব বর্ধমান জেলা এবং পশ্চিম দিকে রয়েছে ঝাড়খন্ড রাজ্য।

পশ্চিম বর্ধমান জেলার জনসংখ্যা

২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী পশ্চিম বর্ধমান জেলার জনসংখ্যা ২৮ লক্ষ ৮২ হাজার ০৩১ জন। এর মধ্য থেকে ৫২ শতাংশ অর্থাৎ ১৪ লক্ষ ৯৭ হাজার ৪৭৯ জন পুরুষ আর বাকি ৪৮ শতাংশ অর্থাৎ ১৩ লক্ষ ৮৪ হাজার ৪৫২ জন মহিলা। এই জেলার ৮৪.৭৫ শতাংশ মানুষ হলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীর।

আর ১৩.৩২ শতাংশ মানুষ মুসলিম সম্প্রদায়ের। ০.৪৪ শতাংশ মানুষ হলেন খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের। এই জেলার প্রায় ২৫ লাখ মানুষ হিন্দু ধর্মাবলম্বীর।

পশ্চিম বর্ধমান জেলার ভূপ্রকৃতি

পশ্চিমবঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা হল পশ্চিম বর্ধমান। এটি বর্ধমান বিভাগের অংশ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক থেকে এই জেলার কোন তুলনা হয় না।

এটি ছোটনাগপুর মালভূমির অংশ। ফলে এই জেলার ভূমিভাগ বেশ খানিকটা অসমতল। এই জেলায় সবুজ গাছপালার পাশাপাশি রয়েছে কয়লা খনি।

পশ্চিম বর্ধমান জেলার জলবায়ু

পশ্চিম বর্ধমান জেলায় গ্রীষ্মের প্রভাব বেশি। এই জেলার আবহাওয়া উষ্ণ প্রকৃতির। এই জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর আশেপাশে আর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর আশেপাশে।

বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় এই জেলায় সবথেকে বেশি বৃষ্টিপাত হয় বর্ষাকালে। পশ্চিম বর্ধমান এর বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত এর পরিমাণ ১ হাজার ৪৪২ মিলিমিটার।

পশ্চিম বর্ধমান জেলার নদ-নদী

এই জেলায় একাধিক নদনদী প্রবাহিত হয়। যেমন- অজয়, নুনিয়া দামোদার ও বরাকার প্রকৃতি। এছাড়াও ছোটখাটো খাল ও বিল দেখতে পাওয়া যায় এই জেলায়।

পশ্চিম বর্ধমান জেলার শিল্প

পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম বর্ধমান জেলা শিল্পের দিক থেকে অন্যতম। এই জেলার দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল উত্তর-পূর্ব ভারতের বৃহৎ শিল্পাঞ্চল গুলির মধ্যে থেকে অন্যতম। এই জেলায় কয়লা খনি রয়েছে।

পশ্চিম বর্ধমান জেলার দর্শনীয় স্থান

এই জেলায় ঘুরে দেখার মত বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে। সেগুলির মধ্যে থেকে কয়েকটি হল-

১. ঘাঘর বুড়ি মন্দির :- এটি পশ্চিম বর্ধমান এর সদর শহর আসানসোলে অবস্থিত। এই মন্দিরে পূজিতা হন রাঢ় বাংলার জাগ্রত দেবী মা শ্রী শ্রী ঘাঘর বুড়ি।

২. মাইথন বাঁধ :- এটি আসানসোল শহরে অবস্থিত। এই বাঁধ থেকে গাছপালা, জলাশয় আর দূরের পাহাড় দেখতে পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য উপভোগ করার জন্য একদম সঠিক জায়গা হল এটি।

এছাড়াও পশ্চিম বর্ধমান এ রয়েছে চুরুলিয়া, শতাব্দি পার্ক, জগন্নাথ মন্দির, কল্যানেশ্বরী মন্দির, সেক্রেড হার্ট চার্জ, বার্নপুর নেহেরু পার্ক ইত্যাদি।

পশ্চিম বর্ধমান জেলার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা

পশ্চিম বর্ধমান জেলায় বেশকিছু স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে। যেমন- আই হসপিটাল, আসানসোল জেলা হাসপাতাল, বাহাদুরপুর রুরাল হসপিটাল, স্টার্লিং হসপিটাল, দুর্গাপুর সাব ডিভিশনাল হসপিটাল, হেল্থ ওয়ার্ল্ড হসপিটাল, দুর্গাপুর মিশন হাসপাতাল, বিবেকানন্দ হাসপাতাল ইত্যাদি।

পশ্চিম বর্ধমান জেলার শিক্ষা ব্যবস্থা

পশ্চিম বর্ধমান জেলায় মোট সাক্ষরতার হার ৭৮.৭৫ শতাংশ। এই জেলায় একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

যেমন- কাজী নজরুল ইসলাম মহাবিদ্যালয়, দুর্গাপুর ওমেন্স কলেজ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি, দেশবন্ধু মহাবিদ্যালয়, বিধানচন্দ্র কলেজ, কাজী নজরুল ইউনিভার্সিটি, আসানসোল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, আসানসোল গার্লস কলেজ ইত্যাদি।

পশ্চিম বর্ধমান জেলার পরিবহন ব্যবস্থা

এই জেলায় উন্নত সড়ক পথ রয়েছে‌। এছাড়াও পরিবহনের জন্য রয়েছে রেলপথ ও আকাশ পথের সুব্যবস্থা। এই জেলার কয়েকটি রেলস্টেশন হল- রানীগঞ্জ রেলস্টেশন, আসানসোল জংশন, দুর্গাপুর রেলস্টেশন, অন্ডাল রেলস্টেশন ইত্যাদি।

এছাড়াও আকাশ পথে যাতায়াতের জন্য এই জেলায় কাজী নজরুল ইসলাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রয়েছে।

পশ্চিম বর্ধমান জেলার উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি

এই জেলার সাথে একাধিক প্রখ্যাত ব্যক্তিবর্গের সম্পর্ক রয়েছে। যেমন-

১. কাজী নজরুল ইসলাম :- তিনি একজন বিখ্যাত কবি, লেখক ও সংগীত শিল্পী ছিলেন। তাঁকে আমরা বিদ্রোহী কবি নামে চিনি।

২. অর্জুন আটওয়াল :- তিনি একজন বিখ্যাত গলফার।

৩. তিমির বিশ্বাস :- তিনি একজন বিখ্যাত বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রের প্লেব্যাক সিঙ্গার।

৪. মিকা সিং :- বর্তমান সময়ের একজন বিখ্যাত গায়ক।

৫. শর্মিলা ঠাকুর :- তিনি একজন বিখ্যাত অভিনেত্রী।

এছাড়াও রয়েছেন বিকাশ চন্দ্র সিং, স্বামী অশোকানন্দ, মুনমুন দত্ত, গিয়াস উদ্দিন দালাল, প্রয়াস রায় বর্মন, সুরিন্দার সিং আলুওয়ালিয়া প্রমূখ।

পশ্চিম বর্ধমান জেলার প্রশাসনিক ব্যবস্থা

এই জেলার সদর শহর হল আসানসোল। পশ্চিম বর্ধমানের ২ টি মহকুমা। যথা :- আসানসোল ও দুর্গাপুর। আর রয়েছে ২ টি পৌরসংস্থা। একটি হল আসানসোল পৌরসংস্থা আর অপরটি হল দুর্গাপুর পৌরসংস্থা। আয়তনের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম পৌরসংস্থা হল আসানসোল।

এই জেলায় ৮ টি ব্লক রয়েছে। যথা :- বারবনি, অন্ডাল, পান্ডবেশ্বর, রানীগঞ্জ, জামুড়িয়া, সালানপুর, কাঁকসা ও লাউদোহা ফরিদপুর। এছাড়াও পশ্চিম বর্ধমানে ১৬ টি থানা আর ৬৫ টি সেন্সাস টাউন রয়েছে।

পাশাপাশি রয়েছে ৬২ টি গ্রাম পঞ্চায়েত আর ৩১৬ টি গ্রাম। এই জেলায় রয়েছে ৮ টি পঞ্চায়েত সমিতি ও ৬১১ টি মৌজা। গ্রাম সংসদ রয়েছে ৮৩৩ টি। জেলা পরিষদ রয়েছে ১ টি। এই জেলায় ২ টি লোকসভা কেন্দ্র রয়েছে। যথা :- আসানসোল আর মাল দুর্গাপুর। আর রয়েছে ৯ টি বিধানসভা কেন্দ্র। যথা :- পাণ্ডবেশ্বর, কুলটি, বারাবনি, দুর্গাপুর পূর্ব, দুর্গাপুর দক্ষিণ, আসানসোল উত্তর, আসানসোল দক্ষিণ, রানীগঞ্জ ও জামুরিয়া।

পশ্চিম বর্ধমান জেলার প্রশ্ন উত্তর

পশ্চিম বর্ধমান কিসের জন্য বিখ্যাত ?

উঃ পশ্চিম বর্ধমান জেলা কয়লা খনি ও শিল্পের জন্য বিখ্যাত।

পশ্চিম বর্ধমান জেলায় কয়টি ব্লক রয়েছে ?

উঃ পশ্চিম বর্ধমান জেলায় ৮ টি ব্লক রয়েছে। যথা :- বারবনি, অন্ডাল, পান্ডবেশ্বর, রানীগঞ্জ, জামুড়িয়া, সালানপুর, কাঁকসা ও লাউদোহা ফরিদপুর।

পশ্চিম বর্ধমান জেলার মহকুমা কয়টি ?

উঃ পশ্চিম বর্ধমানে জেলায় রয়েছে ২ টি মহকুমা। যথা :- আসানসোল ও দুর্গাপুর।

পশ্চিম বর্ধমান জেলায় কয়টি থানা আছে ?

উঃ পশ্চিম বর্ধমানে ১৬ টি থানা আছে।

পশ্চিম বর্ধমান জেলার নামকরণের ইতিহাস কী ?

উঃ বর্ধমান কথার অর্থ সমৃদ্ধি বৃদ্ধির কেন্দ্র। জৈনদের কল্পসূত্র অনুযায়ী মহাবীর জৈন বর্ধমানের অষ্টিকগ্রামে কিছু সময় অতিবাহিত করেছিলেন। মহাবীর জৈনের অপর নাম বর্ধমান। এরপর থেকেই এই অঞ্চলের নাম হয়ে যায় বর্ধমান।

গঙ্গা উপত্যকা থেকে আর্জানাইজেশন এর ফলে সীমান্ত উপনিবেশের বৃদ্ধি হয়। এই কারণে সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে এই অঞ্চলের নাম হয় বর্ধমান।

পশ্চিম বর্ধমান জেলার প্রধান নদ কী ?

উঃ পশ্চিম বর্ধমান জেলার প্রধান নদ অজয়।

পশ্চিম বর্ধমান জেলার কৃষিকাজ সম্পর্কে লেখ।

উঃ চাষের জন্য পশ্চিম বর্ধমান জেলার পরিবেশ অনুকূল। এই জেলায় আলু, ধান, গম ও ভুট্টা চাষ হয়। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ফলমূল, শাকসবজি ও তৈলবীজ চাষ করা হয় এই জেলায়।

পশ্চিম বর্ধমান জেলার পৌরসংস্থা কয়টি ?

উঃ পশ্চিম বর্ধমান জেলায় ২ টি পৌরসংস্থা রয়েছে। একটি হল আসানসোল পৌরসংস্থা আর অপরটি হল দুর্গাপুর পৌরসংস্থা। আয়তনের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম পৌরসংস্থা হল আসানসোল।

উপসংহার :

বর্ধমান কথার অর্থ সমৃদ্ধি বৃদ্ধির কেন্দ্র। জৈনদের কল্পসূত্র অনুযায়ী মহাবীর জৈন বর্ধমানের অষ্টিকগ্রামে কিছু সময় অতিবাহিত করেছিলেন।

মহাবীর জৈনের অপর নাম বর্ধমান। ২০১৭ সালের ৭ ই এপ্রিল এই জেলা আনুষ্ঠানিক ভাবে চালু হয়েছিল। আসানসোল ও দুর্গাপুর মহকুমা নিয়ে গঠিত হয়েছে এই জেলা। পশ্চিম বর্ধমান জেলায় মোট সাক্ষরতার হার ৭৮.৭৫ শতাংশ।

Leave a Comment