দার্জিলিং জেলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ

পশ্চিমবঙ্গের ২৩ টি জেলার মধ্যে থেকে অন্যতম হল দার্জিলিং। এটি একটি শহর এবং পৌরসভা। এটি বিশ্বের একটি খ্যাতনামা পর্যটন কেন্দ্র। দার্জিলিং এর সদর দপ্তর এই শহরেই অবস্থিত। ‘দার্জিলিং’ একটি তিব্বতি শব্দ। এটি’দোর্জে’ ও ‘লিং’ শব্দ থেকে এসেছে। ‘দোর্জে’ কথার অর্থ বজ্রদন্ড আর ‘লিং’ কথার অর্থ কোন স্থান অথবা কোন দেশ। এই জেলার সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে আজকের প্রতিবেদনটি পড়তে পারেন।

দার্জিলিং জেলার ইতিহাস

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম সময় পর্যন্ত দার্জিলিং জেলা সিকিম রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে এই সমগ্র পাহাড়ি অঞ্চল নেপালের গোর্খারা বাজেয়াপ্ত করার চেষ্টা করে। ফলে সিকিম রাজ্যের ছোস র্গ্যালদের সাথে তাদের যুদ্ধ লেগে যায়। দীর্ঘদিন এই যুদ্ধ চলে। সিকিম সেনাবাহিনীকে নেপালিরা তিস্তা নদীর তীর পর্যন্ত সরিয়ে দেয়। নেপালিরা যখন নিজেদের যুদ্ধজয়ের খুশিতে মাতোয়ারা সেই সময় ব্রিটিশরা মাঠে নামে। ১৮১৪ সাল নাগাদ ইংরেজদের সাথে গোর্খাদের যুদ্ধ বাধে।

এই যুদ্ধে গোর্খারা হেরে যায়। আর্থিক তার পরের বছর গোর্খা ও ইংরেজদের মধ্যে সগৌলি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে সিকিম রাজ্যের মেচি নদী থেকে তিস্তা নদী পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি লাভ করে। অবশ্য ১৮১৭ সালে তিতালিয়া চুক্তি স্বাক্ষর হয়। আর এই চুক্তির মাধ্যমে এই সমস্ত অঞ্চল ইংরেজরা ছোস র্গ্যাল দের ফিরিয়ে দেয়।

যখন এই জেলার ওপর ব্রিটিশরা শাসনকার্য শুরু করে সেই সময় এটি অর্থনৈতিক ভাবে অনেকটাই পিছিয়ে ছিল। আর এই কারণেই ভারতবর্ষের অন্যান্য জেলাতে ব্রিটিশরা যেই আইন প্রযোজ্য করেছিল তা এই জেলায় বলবৎ হত না। যখন ভারতে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় তার স্পষ্ট ছাপ পড়েছিল এখানকার চা বাগানগুলিতে। এই জেলার চা শ্রমিকরা ১৯৪০ সাল নাগাদ একত্রিত হয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু করেছিল।

ভারত যখন স্বাধীনতা লাভ করে তখন দার্জিলিং, কার্শিয়াং, কালিম্পং ও তরাই অঞ্চলের কিছুটা অংশ নিয়ে গঠিত হয় দার্জিলিং জেলা‌। এইসব অঞ্চলে পূর্ব পাকিস্তানের বিশাল সংখ্যক উদ্বাস্তু বাঙালি বসবাস শুরু করেছিলেন।

দার্জিলিং জেলার অবস্থান

এই জেলার উত্তর দিকে রয়েছে সিকিম রাজ্য‌। আর দক্ষিণ দিকে রয়েছে বিহার রাজ্যের পূর্ণিয়া জেলা ও পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর জেলা‌। এছাড়াও এই রাজ্যের পূর্ব দিকে রয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভুটান ও জলপাইগুড়ি জেলা‌। আবার পশ্চিম দিকে রয়েছে নেপাল‌।

দার্জিলিং জেলার জনসংখ্যা

২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী এই জেলায় প্রায় ১৮ লাখ ৪৬ হাজার ৮২৩ জন মানুষ বসবাস করেন। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে এই জেলায় ১১ হাজার মানুষের বসবাস।

দার্জিলিং জেলার ভূপ্রকৃতি

এই জেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের আকর্ষণ করার প্রধান কারণ। এই জেলা হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত‌‌। পূর্ব ভারতের উত্তর দিকে অবস্থিত এই জেলা‌। এটিকে পাহাড়ের রানী বলা হয়ে থাকে‌‌। আসলে এই জেলার সদর শহর দার্জিলিং একটি শৈল শহর‌‌। পাহাড়ের পাশাপাশি এখানে রয়েছে অজস্র চা বাগান। এই যে না চায়ের জন্যেও বেশ বিখ্যাত‌।

দার্জিলিং জেলার জলবায়ু

এই জেলায় বেশিরভাগ সময় বর্ষা বিরাজমান। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বর্ষা জলবায়ু অঞ্চলের অন্যতম অংশ হলো এটি। এই জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকে ২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের আশেপাশে। আর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা থাকে -৩ ডিগ্রী সেলসিয়াসের আশেপাশে। সারা বছর বৃষ্টি হওয়ার কারণে এই জেলার বার্ষিক ঝড় বৃষ্টিপাত ৩ হাজার ৩৭ মিলিমিটার।

দার্জিলিং জেলার নদ-নদী

এই জেলার মধ্যে দিয়ে একাধিক নদী প্রবাহিত হয়েছে। তবে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল – মেচি, মহানন্দা, তিস্তা, রঙ্গিত, বালাসন ও রাম্মাম ইত্যাদি‌।

দার্জিলিং জেলার অভয়ারণ্য

এই জেলায় বন জঙ্গল দেখতে পাওয়া যায়। তবে সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যান এই জেলার কেন্দ্রবিন্দু। এটি ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সময় এটি ছিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। এরপর ১৯৯২ সালে এটিকে জাতীয় উদ্যানে রূপান্তরিত করা হয়। এই জেলায় ৩ টি প্রাণী অভয়ারণ্য রয়েছে। সেগুলি হল – সেন্চাল, জোড়পোখরি ও মহানন্দা।

দার্জিলিং জেলার দর্শনীয় স্থান

আগেই বলেছি পশ্চিমবঙ্গের পর্যটক কেন্দ্র গুলির মধ্যে থেকে অন্যতম হল দার্জিলিং। এখানে একাধিক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। যেমন – ডালি মঠ, নাইটিঙ্গেল ঝোপ ঝাড়, ধীরধাম মন্দির, ওল্ড কবরস্থান, আভা আর্ট গ্যালারি, রায় ভিলা, চৌরাস্তা মল, জাপানি মন্দির, টাইগার হিল, দার্জিলিং হিমালয়ান রেলপথে জয় রাইড, পিস প্যাগোডা, ভুটিয়া বুস্তি মঠ, লয়েট বোটানিক্যাল গার্ডেন ইত্যাদি।

দার্জিলিং জেলার প্রতিষ্ঠা‌

এই জেলাটি ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভ করার সময় প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। দার্জিলিং’ একটি তিব্বতি শব্দ। এটি’দোর্জে’ ও ‘লিং’ শব্দ থেকে এসেছে। ‘দোর্জে’ কথার অর্থ বজ্রদন্ড আর ‘লিং’ কথার অর্থ কোন স্থান অথবা কোন দেশ। ভারত যখন স্বাধীনতা লাভ করে তখন দার্জিলিং, কার্শিয়াং, কালিম্পং ও তরাই অঞ্চলের কিছুটা অংশ নিয়ে গঠিত হয় দার্জিলিং জেলা‌। এইসব অঞ্চলে পূর্ব পাকিস্তানের বিশাল সংখ্যক উদ্বাস্তু বাঙালি বসবাস শুরু করেছিলেন।

দার্জিলিং জেলার  শিক্ষা ব্যবস্থা 

দার্জিলিং জেলার মোট সাক্ষরতার হার ৭৯.৯২ শতাংশ। এখানে একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেমন – লরেটো কলেজ, শিলিগুড়ি কলেজ, উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ, উত্তরবঙ্গ ডেন্টাল কলেজ, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়, শিলিগুড়ি কলেজ, কার্শিয়াং কলেজ ইত্যাদি।

দার্জিলিং জেলার  পরিবহন ব্যবস্থা 

এই জেলায় সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা বেশ উন্নত। পাশাপাশি রয়েছে রেলপথ আর আকাশ পথে যাতায়াতের সুব্যবস্থা‌। এই জেলার প্রধান রেলওয়ে স্টেশন হল দার্জিলিং রেলওয়ে স্টেশন। এই যে না এই মাত্র একটি বিমানবন্দর রয়েছে। যার নাম বাগডোগরা এয়ারপোর্ট।

দার্জিলিং জেলার মানুষের ধর্ম

এই জেলায় হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সহ বেশ কিছু অন্যান্য ধর্মের মানুষ বসবাস করে। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী এই জেলায় ৭৬.০৬ শতাংশ মানুষ হিন্দু ধর্মাবলম্বীর। এছাড়াও ৯.৮১ শতাংশ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মমত পালন করেন। আর ৬.৫৪ শতাংশ মানুষ খ্রিস্টান ধর্মমত পালন করেন। এছাড়াও এই জেলার ৫.৪৭ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্ম মতে বিশ্বাসী।

দার্জিলিং জেলার প্রশাসনিক ব্যবস্থা

এই জেলায় ১৪ টি থানা রয়েছে। যথা :- খড়িবাড়ি, মাটিগাড়া, শিলিগুড়ি, ফাঁসি দেওয়া, নকশালবাড়ি, মিরিক, জোড়বাংলো, দার্জিলিং সদর, পুল বাজার, লোধামা, রংলি-রংলিয়ট, সুকিয়াপোখরি, কার্শিয়াং বাগডোগরা।

এই জেলার একমাত্র লোকসভা আসনের নাম হলো দার্জিলিং। তবে দার্জিলিঙে রয়েছে ৬ টি বিধানসভা আসন। যথা :- ফাঁসি দেওয়া, কার্শিয়াং, দার্জিলিং, নকশালবাড়ি, শিলিগুড়ি, মাটিগাড়া।

এই জেলায় মোট ৯২ টি গ্রাম রয়েছে। আর রয়েছে ১ টি জেলা পরিষদ। এছাড়াও এই জেলার গ্রাম পঞ্চায়েত সংখ্যা ১৩৪ টি। আর পঞ্চায়েত সমিতি রয়েছে ৪ টি।

এই জেলার সদর শহর হল দার্জিলিং। এই জেলায় রয়েছে শিলিগুড়ি পৌর সংস্থা। এটিই এই জেলার একমাত্র পৌর সংস্থা। আর রয়েছে ৪ টি মহকুমা। যথা :- শিলিগুড়ি, দার্জিলিং সদর, কার্শিয়াং ও মিরিক। এই জেলায় রয়েছে ৩ টি পৌরসভা। যথা :- দার্জিলিং সদর, কার্শিয়াং ও মিরিক। দার্জিলিঙে রয়েছে মোট ৯ টি ব্লক।

দার্জিলিং জেলার প্রশ্ন উত্তর 

দার্জিলিং কিসের জন্য বিখ্যাত ?

উঃ দার্জিলিং পাহাড় ও চা বাগানের জন্য বিখ্যাত।

দার্জিলিং জেলায় কয়টি ব্লক রয়েছে ?

উঃ দার্জিলিঙে রয়েছে মোট ৯ টি ব্লক। যথা :- খড়িবাড়ি, ফাঁসি দেওয়া, দার্জিলিং পুলবাজার, রংলি-রংলিয়ট, জোড় বাংলো সুকিয়াপোখরি, কার্শিয়াং, মিরিক, নকশালবাড়ি।

দার্জিলিং জেলার মহকুমা কয়টি ?

উঃ এই জেলায় রয়েছে ৪ টি মহকুমা। যথা :- শিলিগুড়ি, দার্জিলিং সদর, কার্শিয়াং ও মিরিক।

দার্জিলিং জেলায় কয়টি থানা আছে ?

উঃ এই জেলায় ১৪ টি থানা রয়েছে। যথা :- খড়িবাড়ি, মাটিগাড়া, শিলিগুড়ি, ফাঁসি দেওয়া, নকশালবাড়ি, মিরিক, জোড়বাংলো, দার্জিলিং সদর, পুল বাজার, লোধামা, রংলি-রংলিয়ট, সুকিয়াপোখরি, কার্শিয়াং বাগডোগরা।

দার্জিলিং জেলার প্রতিষ্ঠা কবে হয় ?

উঃ এই জেলা ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।

দার্জিলিং জেলার প্রধান নদী কোনটি ?

উঃ এই জেলার প্রধান নদী তিস্তা।

দার্জিলিং জেলার পাহাড় কোনটি ?

উঃ এই জেলায় একাধিক পাহাড়-পর্বত রয়েছে। এই জেলার সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ হল সান্দাকফু। এই পর্বতের উচ্চতা ৩ হাজার ৬৩০ মিটার। এছাড়াও রয়েছে টাইগার হিল, টাংলু ও ফালুট।

দার্জিলিং জেলার পৌরসভা কয়টি ?

উঃ এই জেলায় রয়েছে ৩ টি পৌরসভা। যথা :- দার্জিলিং সদর, কার্শিয়াং ও মিরিক।

উপসংহার :

এটি বিশ্বের একটি খ্যাতনামা পর্যটন কেন্দ্র। দার্জিলিং এর সদর দপ্তর এই শহরেই অবস্থিত। ‘দার্জিলিং’ একটি তিব্বতি শব্দ। এটি’দোর্জে’ ও ‘লিং’ শব্দ থেকে এসেছে। ‘দোর্জে’ কথার অর্থ বজ্রদন্ড আর ‘লিং’ কথার অর্থ কোন স্থান অথবা কোন দেশ। দার্জিলিং পাহাড় ও চা বাগানের জন্য বিখ্যাত।

এই জেলায় একাধিক পাহাড়-পর্বত রয়েছে। এই জেলার সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ হল সান্দাকফু। এই পর্বতের উচ্চতা ৩ হাজার ৬৩০ মিটার। এছাড়াও রয়েছে টাইগার হিল, টাংলু ও ফালুট। রয়েছে টাইগার হিল, টাংলু ও ফালুট।

Leave a Comment