ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গ 20 তম জেলা হিসাবে ২৫শে জুন, ২০১৪ সালে জলপাইগুড়ি জেলা থেকে আলিপুরদুয়ার জেলার আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই এই জেলার আয়তন ৩১৩৬ বর্গ কিলোমিটার। আলিপুরদুয়ার ডুয়ার্সের রানী হিসাবে পরিচিত।
ভৌগোলিকভাবে আলিপুরদুয়ার পশ্চিমে জলপাইগুড়ি, পূর্বে আসাম এবং দক্ষিণে কোচবিহারের সীমানায় অবস্থিত একটি স্থলবেষ্টিত জেলা। উত্তরে জেলাটি ভুটানের সাথে একটি আন্তর্জাতিক সীমান্ত রেখা ভাগ করেছে।
আলিপুরদুয়ার জেলাটি ডুয়ার্স এর ঘন বন্যভূমি , চা বাগান এবং নদনদী ও উর্বর সমতল ভূমি নিয়ে গঠিত । বাঘ, গন্ডার এবং হাতির মতো বেশ কয়েকটি বিরল বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী ডুয়ার্সের বনে উপলব্ধ। এই জালটিতে সব সময়েই মনোরম আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত।
ইতিহাস :
আলিপুরদুয়ার ভুটান এবং তিব্বতের সাথে সিল্ক রুট নামে বিখ্যাত বাণিজ্য পথের সাথে যুক্ত ছিল। আলিপুরদুয়ারের কাছে সাঁওতালাবাড়িতে এখনও ঐতিহ্যবাহী পথের অবশিষ্টাংশ দেখা যায়।
আলিপুরদুয়ারের নাম কর্নেল হেদায়ত আলী খান থেকে এসেছে যিনি ভুটান যুদ্ধে গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা পালন করেছিলেন এবং 1865 সালে দ্বিতীয় অ্যাংলো ভুটান যুদ্ধের পর প্রথম অতিরিক্ত সহকারী কমিশনার হিসেবে এখানে নিযুক্ত ছিলেন।
আলিপুরদুয়ার নামের তিনটি অংশ রয়েছে। প্রথম অংশ “আলি” কর্নেল হেদায়ত আলী খানের নাম থেকে নেওয়া হয়েছে যিনি এখানে থাকতেন এবং ভুটানের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। “পুর” অর্থ বাসস্থান এবং “দুয়ার” শব্দের উৎপত্তি “ডুয়ার্স” অঞ্চলের নামে।
ভূগোল :
কলকাতা থেকে আলিপুরদুয়ারের দূরত্ব 684 কিমি। ভৌগলিকভাবে জেলাটি ২৬.৪°N থেকে ২৬.৮৩°N এবং ৮৯°E থেকে ৮৯.৯°E এর মধ্যে অবস্থিত।
এটি পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ার্সের পূর্ব প্রান্তে একটি বিস্তৃত এলাকা। ভুটানের বাইরের হিমালয় পর্বতমালা থেকে অসংখ্য নদী এই জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। আলিপুরদুয়ার জেলা বেশিরভাগ ডুয়ার্সের জঙ্গলে আচ্ছাদিত। এই জেলার জলবায়ু উষ্ণ ও আর্দ্র। জেলার গড় বৃষ্টিপাত 350 সেমি। পশ্চিমবঙ্গের সর্বাধিক বৃষ্টিপাত বক্সাফোর্ট অঞ্চলে হয়ে থাকে।
বাস্তুতন্ত্র :
বাঘ, গন্ডার এবং হাতির মতো বেশ কয়েকটি বিরল বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী ডুয়ার্সের বনে উপলব্ধ।
অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের হরিণ, বাইসন, পাখি এবং বিভিন্ন সরীসৃপ।
অর্থনীতি :
আলিপুরদুয়ার জেলার অর্থনীতি তিনটি ‘T’-এর – চা (Tea), পর্যটন (Tourism) এবং সেগুন কাঠের (Teak Wood) উপর ভিত্তি করে। প্রাকৃতক নৈসর্গের টানে প্রতিবছর দেশী ও বিদেশী বহু পর্যটক এখানে আসেন।
পর্যটনের সাথে এখানে বহুমানুষের জীবিকা জড়িত বলে পর্যটন এই অঞ্চলের অর্থুনীততে একটি গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা পালন করে। ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এই হস্তশিল্পের জন্য বিশেষভাবে চিহ্নিত। বেত এবং বাঁশের কারুকাজ, কাঠের খোদাই, পাটজাত দ্রব্য, মৃৎশিল্প, চা, সূচিশিল্প ইত্যাদী এখানকার উল্লেখযোগ্য হস্তশিল্প হিসেবে বিখ্যাত।
আলিপুরদুয়ার এবং মাদারিহাট অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি পরিবারে বিবিধ হস্তশিল্পের কারিগরি অনুশীলন প্রজন্মের মধ্য দিয়ে চলে এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও এই শিল্পের প্রতি অসীম আগ্রহ লক্ষণীয়।
পরিবহন :
আলিপুরদুয়ার জেলা সড়ক এবং রেল পথে সারা ভারত ও ভুটানের সাথে সুসংযুক্ত। এছাড়া আকাশপথে বাগডোগরা বিমানবন্দরটি নিকটতম বিমান সংযোগ। বাগডোগরা বিমানবন্দর (IXB), এই জেলার সদর থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে। আসামের গুয়াহাটির বোরঝার বিমানবন্দর প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে।
রেলপথে মাধ্যমে দেশের অন্যান্য বড় শহর থেকে আলিপুরদুয়ার পর্যন্ত নিয়মিত ট্রেন রয়েছে। এই জেলায় উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলওয়ের (North East Frontier Railway) বিভাগীয় সদর দপ্তর রয়েছে। আলিপুরদুয়ার জংশন (APDJ) এই জেলার সবছে বড়ো রেলওয়ে স্টেশন। এই স্টেশন থাকে প্রতিদিন দেশের রাজধানী ও বিভিন্ন গন্তব্যের জন ট্রেন রয়েছে। নিউ আলিপুরদুয়ার (NOQ) এই জেলার আরেকটি অন্যতম রেলওয়ে স্টেশন।
সড়কপথে আলিপুরদুয়ার থেকে শিলিগুড়ি এবং জলপাইগুড়ির পাশাপাশি কোচবিহার-শিলিগুড়ি এবং কোচবিহার-জলপাইগুড়ি রুটে বেশিরভাগ ব্যক্তিগত বাস চলাচল করে। ৩১৭এ জাতীয় সড়ক (National Highway) দ্বারা ভুটানের সাথে যুক্ত। জাতীয় সড়ক ১৭ মাধ্যমে এই জেলা কোচবিহার, ধুবড়ি , গুহাটি সাথে সংযুক্ত। এছাড়াও ২৭ ও ৩১৭ জাতীয় সড়ক এই জেলার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে।
শিক্ষা :
আলিপুরদুয়ার জেলায় শিক্ষার হার ৬৪.৭%। জেলায় সরকারী এবং বেসরকারী মিলিয়ে মোট ৩০৮টি স্কুল আছে। এছাড়া মোট দশটি কলেজ, একটি ইউনিভার্সিটি এবং একটি কারিগরিবিদ্যার কলেজ আছে।
সংস্কৃতি :
বহুসংস্কৃতির জেলা আলিপুরদুয়ার। এখানকার মানুষ শিল্প ও সংস্কৃতির অনুরাগী। জেলাটিতে বোড়ো, রাভা, মেচ, সাঁওতাল এবং রাজবংশীর মতো উপজাতীয় সম্প্রদায়ের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। তাদের শিল্প ও সঙ্গীতের নিজস্ব এবং স্বতন্ত্র ধারা রয়েছে। এ জেলার গ্রামের মানুষের বাড়ির মাটির দেয়ালে সুন্দর ছবি অঙ্কন করে।
জেলার প্রধান উৎস গুলির মধ্যে রয়েছে দুর্গা পূজা, ছট পূজা, গণেশ পূজা, লক্ষ্মী পূজা, সরস্বতী পূজা এবং দীপাবলি। আলিপুরদুয়ারের অন্যতম জনপ্রিয় মেলা হল ডুয়ার্স উৎসব যা প্রতি বছর জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয়।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থা :
জেলায় মোট ২৬টি সরকারী হাঁসপাতাল এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে। এরমধ্য মেডিকেল কলেজ এবং জেনারেল হাঁসপাতাল (মোট ৬টি মোট সজ্জা ১০৬০টি), গ্রামীন হাঁসপাতাল ৭টি (মোট সজ্জা ২০০টি) এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র মোট ১৩টি (মোট সজ্জা ৯৮টি) আছে।
এছাড়াও জেলায় মোট ১৮টি বেসরকারী হাঁসপাতাল এবং নার্সিংহোম আছে যাদের সম্মিলিত শয্যাসংখ্যা ৪৫৩টি। জেলা হাঁসপাতাল আলিপুরদুয়ার শহরে অবস্থিত।
প্রশাসনিক ব্যবস্থা :
এটি একটি প্রধানত গ্রামীণ এলাকা যেখানে 79.38% জনসংখ্যা গ্রামীণ এলাকায় বসবাস করে। জেলাটির 1টি পৌর শহর এবং 20টি সেন্সাস টাউন রয়েছে এবং এর মানে হল যে 20.62% জনসংখ্যা শহরাঞ্চলে বাস করে।
এই জেলায় আলিপুরদুয়ার পৌরসভা এবং মাদারিহাট-বীরপাড়া, আলিপুরদুয়ার-I, আলিপুরদুয়ার-II, ফালাকাটা, কালচিনি এবং কুমারগ্রাম নামে ছয়টি সম্প্রদায় উন্নয়ন ব্লক নিয়ে গঠিত। ছয়টি ব্লকে ৬৬টি গ্রাম পঞ্চায়েত এবং নয়টি সেন্সাস টাউন রয়েছে।
তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতি, একত্রিত হয়ে জেলার ছয়টি সম্প্রদায় উন্নয়ন ব্লকের অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা গঠন করে। জেলার তিনটি উত্তর ব্লকে আদিবাসীদের (তফসিলি উপজাতি) সংখ্যা বেশি।
এখানে মূলত রাভা, গারো, মেচ, টোটো এবং ধিমালের মতো আদিবাসী উপজাতি বসবাস করত।
- মহকুমা- ১টি (আলিপুরদুয়ার)
- পৌরসভা- ২ (আলিপুরদুয়ার, ফালাকাটা)
- ব্লক- ৬ (মাদারিহাট, ফালাকাটা, কালচিনি, আলিপুরদুয়ার-১, আলিপুরদুয়ার-২, কুমারগ্রাম)
- পঞ্চায়েত সমিতি- ৬টি
- গ্রাম পঞ্চায়েত- ৬৬টি
- থানার মোট সংখ্যা- 8টি
- পুলিশ ফাঁড়ির মোট সংখ্যা- ৩টি
জনসংখ্যার তথ্য :
ভারতের ২০১১ সালের জনগণনানুসারে, জেলার হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ১৯৬৪৩৭ যা জেলার মোট জনসংখ্যার ৯০.৫৫%। মুসলমান জনসংখ্যা ১২,৮৬৯; যা মোট জনসংখ্যার ৫.৯৩%।
খ্রিস্টান জনসংখ্যা ৫,৫১৬ এবং জনসংখ্যার ২.৫৪%। অন্যান্য ধর্মালম্বিদের সংখ্যা ২১০৯, যা মোট জনসংখ্যার ০.৯৮%।
ভাষা :
জেলার অধিকাংশ মানুষের ভাষা বাংলা। এছাড়াও সাদরি, হিন্দী, নেপালি এবং রাজবংশি ভাষাভাষীর মানুষও এখানে বসবাস করেন। শতকরা হিসেবে ভাষাভাষীর সংখ্যা যথাক্রমেঃ বাংলা (৫০.২৮%); সাদরি (১৬.৮%); নেপালি (৯.৭%) হিন্দি (৩.৬৭%); রাজবংশী (৩.১৭%) ।
ধর্ম :
এই জেলায় হিন্দুরা অধিক সংখ্যায় বসবাস করে। হিন্দু ছাড়াও মুসলমান, খ্রীষ্টান এবং অন্যন্য ধর্মালম্বী মানুষেরা শান্তিপুর্ণভাবে সহাবস্থান করে থাকে।
দর্শনীয় স্থান :
আলিপুরদুয়ার জেলার উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি:
- দীপক বর্মন- বিধায়ক
- জোয়াসিম বাক্সলা- বিধায়ক
- উইলসন চাপরামারী- বিধায়ক
- ইসরায়েল গুরুং- প্রাক্তন ফুটবল খেলোয়াড়
- মনোজ কুমার ওঁরাও- বিধায়ক
- সৌমেন রায়- প্রাক্তন বিধায়ক
- অঞ্জু তামাং- মহিলা ফুটবল খেলোয়াড়
- মনোজ টিজ্ঞা- বিধায়ক
- পিয়ুস তীরকে- সাংসদ
উপসংহার :
পশ্চিমবঙ্গের একটি অন্যতম সুন্দর জেলা হিসেবে আলিপুরদুয়ারের নাম বারংবার উচ্চারিত হয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, আর সরল মানুষের সহাবস্থান এই জেলাটিকে অন্য জেলার থেকে সতন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সাম্প্রতিক কালে সরকারি প্রচেষ্ঠায় শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং শিল্পে এই জেলাটি ক্রমশ এগিয়ে চলেছে।