পূর্ব মেদিনীপুর পশ্চিমবঙ্গের ২৩ টি জেলার মধ্যে থেকে অন্যতম। এটি মেদিনীপুর বিভাগের একটি জেলা। এই জেলার সদর দপ্তর হল তমলুক। এখানকার মোট আয়তন ৪ হাজার ৭৩৬ বর্গ কিলোমিটার। এই জেলায় মোট ৫ লাখ ৫০ হাজার জন মানুষ বসবাস করেন। এই জেলার সাথে যুক্ত আছে ন্যাশনাল হাইওয়ে ১৬, ন্যাশনাল হাইওয়ে ১১৬, ন্যাশনাল হাইওয়ে ১১৬ বি। এই জেলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ আজ আপনারা পেয়ে যাবেন আমাদের প্রতিবেদনে।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ইতিহাস
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই জেলার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। ২০০২ সালের ১ লা জানুয়ারি মেদিনীপুর জেলা ২ টি ভাগে বিভক্ত হয়। অবিভক্ত মেদিনীপুরের পূর্বাংশই হল পূর্ব মেদিনীপুর জেলা। মেদিনীপুর জেলার তমলুক, হলদিয়া, কাঁথি এগরা নিয়ে গঠিত হয়েছে এই জেলা।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার অবস্থান
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার উত্তরে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা আর হাওড়া জেলা অবস্থিত। এই জেলার দক্ষিণ দিকে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। পূর্ব দিকে রয়েছে হুগলি নদী ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা। এছাড়া পশ্চিম দিকে রয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা ও ওড়িশা রাজ্য। এই জেলার মোট আয়তন ৪ হাজার ৭৩৬ বর্গ কিলোমিটার। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার জনঘনত্ব হল প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১২০ জন।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার জনসংখ্যা
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী এই জেলায় ৫ লাখ ৫০ হাজার মানুষের বসবাস। মোট জনসংখ্যার ৮৭.৬৬ শতাংশ মানুষ শিক্ষিত। লিংগানুপাত হল প্রতি ১০০০ পুরুষে ৯৩৬ জন মহিলা।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ভূপ্রকৃতি
এই জেলার ভূপ্রকৃতি খুবই সুন্দর। এটি উপকূলবর্তী জেলা। এখানে মৌসুমী জলবায়ু দেখতে পাওয়া যায়।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ভাষা
এই জেলার প্রধান ভাষা হল বাংলা। এখানকার ৯৮.২৮ শতাংশ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। আর ০.৭০ শতাংশ মানুষ কথা বলার জন্য বেছে নিয়েছেন হিন্দি ভাষাকে। এছাড়াও বাকি ১.০২ শতাংশ মানুষ অন্যান্য ভাষায় কথা বলেন।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নদ-নদী
এই জেলার উপকূলীয় অঞ্চল হুগলি নদীর মুখোমুখি অবস্থিত। এখানে একাধিক নদনদী রয়েছে। যেমন – রসুলপুর নদী, হুগলি নদী, হলদি নদী, কংসাবতী নদী ও কেলেঘাই নদী। তবে কংসাবতী নদী মেদিনীপুর জেলার দুঃখের নদী। এই নদীটি পুরুলিয়া জেলার অযোধ্যা পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এরপর পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর ও পূর্ব মেদিনীপুরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে হলদি নদীর সাথে মিশেছে। পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় এই নদীর ভূমির ঢাল একেবারে কমে যায়। ফলে একটু বেশি বৃষ্টিপাত হলেই অতিরিক্ত জল জমে ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি করে। যে কারণে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির দেখা দেয়।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পার্ক
পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় একাধিক পার্ক রয়েছে। যেমন – নিজ খয়রা পার্ক, বেকার বেঞ্চ, গোল্ডেন পার্ক, হলদিয়া গেট পার্ক, এগরা পৌর পার্ক, বন্দেমাতরম পার্ক, নন্দকুমার সার্কেল পার্ক ইত্যাদি।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার দর্শনীয় স্থান
পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় একাধিক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। যেমন –
১. তমলুক প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর :- এখানে গ্রীক শিলালিপিতে তাম্রলিপ্ত সংরক্ষণ করা আছে। এছাড়াও তাম্র যুগের প্রত্নতত্ত্ব এখানে রাখা আছে।
২. রক্ষিত বাটি :- এখানে বিপ্লবী দল অনুশীলন সমিতি আর গুপ্ত সমিতির গোপন কেন্দ্র ছিল।
৩. মহিষাদল :- এখানে মহিষাদল রাজবাড়ি আর জাদুঘর রয়েছে। এছাড়াও এটি ৩ টি নদীর সংযোগস্থল হওয়ায়, এখানে পিকনিক করাও যায়।
৪. দীঘা :- পূর্ব মেদিনীপুরের অন্যতম বিখ্যাত জায়গা হল এটি। এখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ সমুদ্র সৈকত উপভোগ করতে ভিড় জমান। দিঘার প্রকৃত নাম হলো বীরকুল। ব্রিটিশ ভ্রমণকারী জনপ্রাঙ্ক স্মিথের লেখালেখির কারণে ১৯২৩ সাল থেকে দীঘা মানুষের আগ্রহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
৫. মন্দারমনি :- এটি পূর্ব মেদিনীপুরের আরেকটি সমুদ্র সৈকত। এটি বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত। মন্দারমনি ছোট মৎস্য বন্দর। সাম্প্রতিক সময়ে এখানেও পর্যটকদের যাতায়াত বৃদ্ধি পেয়েছে।
এছাড়াও এখানে রয়েছে – জগন্নাথ মন্দির, রাম জী মন্দির, মহাপ্রভু মন্দির, রাজবাড়ী মন্দির, হরি মন্দির, পাঁশকুড়া, হলদিয়া ইত্যাদি বিখ্যাত পর্যটন স্থান।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার অর্থনীতি
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার অর্থনীতি নির্ভর করছে মূলত কৃষি আর শিল্পের ওপর। তবে গত কয়েক বছরে পর্যটন ব্যবসা এখানে বেশ বড় আকার ধারণ করেছে। দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চল হলদিয়া, এই জেলাতেই অবস্থিত। এছাড়াও দীঘা, মন্দারমনি ও তাজপুর -এর মতো পর্যটন কেন্দ্রগুলিও পূর্ব মেদিনীপুরেই অবস্থিত।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার শিক্ষা ব্যবস্থা
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মোট জনসংখ্যার ৮৭.৬৬ শতাংশ মানুষ শিক্ষিত। এই জেলার কয়েকটি শিক্ষা কেন্দ্র হল – তমলুক হ্যামিলটন উচ্চ বিদ্যালয়, রাজকুমারীর সন্তনময়ী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, কন্টাই হাই স্কুল, শ্রীরামপুর কৃষি উচ্চ বিদ্যালয়।
এছাড়াও এখানে একাধিক কলেজ রয়েছে। যেমন –
১. এগরা সারদা শশীভূষণ কলেজ – জেনারেল ডিগ্রী কলেজ
২. খেজুরি কলেজ – জেনারেল ডিগ্রী কলেজ
৩. তাম্রলিপ্ত মহাবিদ্যালয়
৪. দেশাপ্রণ মহাবিদ্যালয়
৫. পাঁশকুড়া বনমালী কলেজ
৬. প্রভাত কুমার কলেজ – জেনারেল ডিগ্রী কলেজ
৭. বিবেকানন্দ মিশন মহাবিদ্যালয়
৮. ময়না কলেজ – জেনারেল ডিগ্রী কলেজ
৯. মহারাজা নন্দকুমার মহাবিদ্যালয় – জেনারেল ডিগ্রী কলেজ
১০. মহিষাদল রাজ কলেজ – জেনারেল ডিগ্রী কলেজ
১১. রবীন্দ্রভারতী মহাবিদ্যালয় – জেনারেল ডিগ্রী কলেজ
১২. রমনগর কলেজ – জেনারেল ডিগ্রী কলেজ
১৩. শহীদ মাতঙ্গিনী মহিলা মহাবিদ্যালয় – মহিলা সরকারি কলেজ
১৪. সিদ্ধিনাথ মহাবিদ্যালয় – জেনারেল ডিগ্রী কলেজ
১৫. সীতানন্দা কলেজ – জেনারেল ডিগ্রী কলেজ
১৬. হলদিয়া সরকারি কলেজ – জেনারেল ডিগ্রী কলেজ
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পরিবহন ব্যবস্থা
এখানে যাতায়াতের জন্য সড়ক পথ, রেলপথ ও জলপথের সুব্যবস্থা রয়েছে। এই জেলার সাথে যুক্ত আছে ন্যাশনাল হাইওয়ে ১৬, ন্যাশনাল হাইওয়ে ১১৬, ন্যাশনাল হাইওয়ে ১১৬ বি।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুক নামের উৎপত্তি
তমলুক নামটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘তাম্রলিপ্ত’ থেকে। এই কথাটির অর্থ তামার পূর্ণ। জনশ্রুতি অনুযায়ী, তাম্রলিপ্ত নামটি এসেছে ময়ূরা-ধ্বজা রাজবংশের রাজা তাম্রধ্বজা -র নাম থেকে। মনে করা হয় এই রাজার বিশাল ব্যবসা ছিল। তামার ব্যবসার মাধ্যমেই এই অঞ্চলে সমৃদ্ধি এসেছিল। তাই রাজার সম্মানে ও তাঁর ব্যবসা অনুযায়ী এই অঞ্চলের নাম হয় তাম্রলিপ্ত অর্থাৎ তমলুক।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার প্রশাসনিক ব্যবস্থা
পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় ৪ টি মহকুমা রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে ২৯ টি থানা ও ২৫ টি ব্লক।
এই জেলায় ৪ টি লোকসভা কেন্দ্র রয়েছে। যথা :- কাঁথি, তমলুক, ঘাটাল (আংশিক), মেদিনীপুর (আংশিক)। এছাড়াও রয়েছে ১৬ টি বিধানসভা আসন। যথা :-
১. তমলুক
২. পূর্ব পাঁশকুড়া
৩. পাঁশকুড়া
৪. ময়না
৫. নন্দকুমার
৬. মহিষাদল
৭. হলদিয়া
৮. নন্দীগ্রাম
৯. চাঁদপুর
১০. পটাশপুর
১১. কাঁথি উত্তর
১২. ভগবানপুর
১৩. খেজুরি
১৪. কাঁথি দক্ষিণ
১৫. রামনগর
১৬. এগরা
পূর্ব মেদিনীপুর জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত ?
উঃ পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সমুদ্র সৈকতের জন্য বিখ্যাত।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় কয়টি লোকসভা কেন্দ্র রয়েছে ?
উঃ এই জেলায় ৪ টি লোকসভা কেন্দ্র রয়েছে। যথা :- কাঁথি, তমলুক, ঘাটাল (আংশিক), মেদিনীপুর (আংশিক)।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মহকুমা কয়টি ?
উঃ পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় ৪ টি মহকুমা রয়েছে।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় কয়টি থানা আছে ?
উঃ পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় রয়েছে ২৯ টি থানা।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পর্যটন ব্যবসা সম্পর্কে লেখ।
উঃ পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ভ্রমণ পিপাসু। ছুটি পেলেই তাঁরা চেষ্টা করেন কাছে পিঠে কোথাও ঘুরে আসার। পূর্ব মেদিনীপুর তাই পর্যটকদের জন্য হয়ে উঠেছে পীঠস্থান। এখানে স্বল্প বাজেটে সহজেই ঘোরা যায়। দীঘা থেকে শুরু করে মন্দারমনি একাধিক সমুদ্র সৈকত আছে এই জেলায়। আর এগুলিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে পর্যটন ব্যবসা। যা বর্তমানে রমরমিয়ে চলছে।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার প্রধান নদী কোনটি ?
উঃ পূর্ব মেদিনীপুর জেলার প্রধান নদী হল কংসাবতী।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পাহাড় সম্পর্কে লেখ।
উঃ পূর্ব মেদিনীপুর জেলা উপকূলবর্তী অঞ্চল। এখানে একাধিক সমুদ্র সৈকত রয়েছে, তবে কোন পাহাড় নেই।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার বিধানসভা আসন কয়টি ?
উঃ এই জেলায় রয়েছে ১৬ টি বিধানসভা আসন। যথা :-
১. তমলুক
২. পূর্ব পাঁশকুড়া
৩. পাঁশকুড়া
৪. ময়না
৫. নন্দকুমার
৬. মহিষাদল
৭. হলদিয়া
৮. নন্দীগ্রাম
৯. চাঁদপুর
১০. পটাশপুর
১১. কাঁথি উত্তর
১২. ভগবানপুর
১৩. খেজুরি
১৪. কাঁথি দক্ষিণ
১৫. রামনগর
১৬. এগরা
উপসংহার :
পূর্ব মেদিনীপুর পশ্চিমবঙ্গের ২৩ টি জেলার মধ্যে থেকে অন্যতম। এটি মেদিনীপুর বিভাগের একটি জেলা। এই জেলার সদর দপ্তর হল তমলুক। তমলুক নামটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘তাম্রলিপ্তা’ থেকে। এই কথাটির অর্থ তামার পূর্ণ। জনশ্রুতি অনুযায়ী, তাম্রলিপ্ত নামটি এসেছে ময়ূরা-ধ্বজা রাজবংশের রাজা তাম্রধ্বজা -র নাম থেকে। মনে করা হয় এই রাজার বিশাল ব্যবসা ছিল। তামার ব্যবসার মাধ্যমেই এই অঞ্চলের সমৃদ্ধি এসেছিল। তাই রাজার সন্ধানে ও তাঁর ব্যবসা অনুযায়ী এই অঞ্চলের নাম হয় তাম্রলিপ্ত অর্থাৎ তমলুক। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ভ্রমণ পিপাসু। ছুটি পেলেই তারা চেষ্টা করেন কাছে পিঠে কোথাও ঘুরে আসার। পূর্ব মেদিনীপুর তাই পর্যটকদের জন্য হয়ে উঠেছে পীঠস্থান। এখানে স্বল্প বাজেটে সহজেই ঘোরা যায়। দীঘা থেকে শুরু করে মন্দারমনি একাধিক সমুদ্র সৈকত আছে এই জেলায়। আর এগুলিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে পর্যটন ব্যবসা। যা বর্তমানে রমরমিয়ে চলছে।