মুর্শিদাবাদ জেলা পশ্চিমবঙ্গের মালদা বিভাগের অন্তর্গত। এটি একটি জনবহুল জেলা। জনসংখ্যার দিক থেকে ভারতের ৬৪১ টি জেলার মধ্যে মুর্শিদাবাদের স্থান নবম। এই জেলার সদর দপ্তর হল বহরমপুর। মুর্শিদাবাদের মধ্য দিয়ে ভাগীরথী নদী বয়ে গেছে। এর ফলে মুর্শিদাবাদ ২ ভাগে বিভক্ত হয়েছে। এই নদীর পশ্চিম অংশ হল রাঢ় অঞ্চল আর পূর্ব অংশ হল বাগড়ি অঞ্চল। এই জেলার আয়তন ২ হাজার ৬২ বর্গমাইল। আজ এই জেলা সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
মুর্শিদাবাদ জেলার ইতিহাস
খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে গৌড় অঞ্চলের রাজা ছিলেন শশাঙ্ক। তাঁর রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ। এই কর্ণসুবর্ণ মুর্শিদাবাদের অঞ্চল ছিল। খুব সম্ভবত পাল রাজা মহিপালের রাজধানীও এই অঞ্চলেই ছিল। অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে এই জেলার নাম হয় মুর্শিদাবাদ। আর বর্তমানের আকারটি ওই শতকেরই শেষের দিকে পাওয়া গেছিল।
আসলে মুর্শিদাবাদের নাম মুর্শিদকুলি খানের নাম অনুযায়ী রাখা হয়েছিল। মুর্শিদকুলি খান এই জেলার প্রতিষ্ঠাতা। ১৭০৪ সালে এই জেলার নাম মুর্শিদাবাদ হয়। নবাব মুর্শিদকুলি খান মুর্শিদাবাদ জেলাকে তৎকালীন বাংলার রাজধানী করেছিলেন। পলাশীর যুদ্ধের পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই জেলাতে বহু বছর রাজত্ব করেছিল।
১৯১২ সালে মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটি গঠিত হয়। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নেতা ব্রজ ভূষণ গুপ্তের সভাপতিত্বে এটি গঠিত হয়েছিল। এই জেলাতে স্বদেশী আন্দোলন ও ভারত ছাড়ো আন্দোলন সক্রিয় ছিল। আপনারা জানলে হয়তো অবাক হবেন ভারত স্বাধীন হওয়ার পর এই জেলা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়েছিল। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ১৭ ই আগস্ট চূড়ান্ত সীমানা নির্ধারণ করে এই জেলাকে ভারতীয় অধিসংঘে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল।
মুর্শিদাবাদ জেলার অবস্থান
মুর্শিদাবাদ জেলা ২৩° ৪৩’ ও ২৪° ৫২’ উত্তর অক্ষাংশে আর ৮৭° ৪৯’ ও ৮৮° ৪৪’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। এই জেলাটি পশ্চিমবঙ্গের মধ্যভাগে অবস্থিত। এর আকার অনেকটা ত্রিভুজের মতো। মুর্শিদাবাদের উত্তর দিকে মালদহ জেলা ও বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা অবস্থিত। আর দক্ষিণ দিকে নদীয়া জেলা অবস্থিত। এছাড়াও এই জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে রয়েছে পূর্ব বর্ধমান জেলা। আর পশ্চিম দিকে রয়েছে বীরভূম জেলা এবং উত্তর-পশ্চিম দিকে রয়েছে ঝাড়খন্ডের পাকুড় জেলা।
মুর্শিদাবাদ জেলার জনসংখ্যা
এটি একটি জনবহুল জেলা। জনসংখ্যার নিরিখে থেকে ভারতের ৬৪১ টি জেলার মধ্যে মুর্শিদাবাদের স্থান নবম। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী এই জেলার মোট জনসংখ্যা ৭১ লক্ষ ৩ হাজার ৮০৭ জন। মুর্শিদাবাদ জেলার জনঘনত্ব হল প্রতি বর্গমাইলে ৩ হাজার ৪৬০ জন। এই জেলার লিঙ্গানুপাত ১০০০ : ৯৫৮ (পুরুষ : মহিলা)।
মুর্শিদাবাদ জেলার ভূপ্রকৃতি
এই জেলার প্রাকৃতিক পরিবেশ অতুলনীয়। এখানকার আবহাওয়া উষ্ণ।
মুর্শিদাবাদ জেলার জলবায়ু
মুর্শিদাবাদ জেলার জলবায়ু উষ্ণ আর্দ্র ক্রান্তীয় মৌসুমী প্রকৃতির। গ্রীষ্মকালে এখানকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে আর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা থাকে ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে। গ্রীষ্মকালে এখানে কালবৈশাখী ঝড় হয়।
মুর্শিদাবাদ জেলার নদ-নদী
এই জেলায় একাধিক নদ-নদী রয়েছে। মুর্শিদাবাদের মধ্য দিয়ে ভাগীরথী নদী বয়ে গেছে। এর ফলে মুর্শিদাবাদ ২ ভাগে বিভক্ত হয়েছে। এই নদীর পশ্চিম অংশ হল রাঢ় অঞ্চল আর পূর্ব অংশ হল বাগড়ি অঞ্চল। এছাড়াও রয়েছে – গঙ্গা, পদ্মা, সুতি, ভৈরব, কুয়ো, জলঙ্গী, ময়ূরাক্ষী, শিয়ালমারী, বাবলা ইত্যাদি।
এই জেলায় বেশকিছু খাল-বিল রয়েছে। যেমন – তেলকর বিল, পাত বিল, ভান্ডারদহ বিল, সুজাপুর দামোস, চালতিয়া বিল, পাগলা দাঁড়া, আহিরন বিল ইত্যাদি।
মুর্শিদাবাদ জেলার ভাষা
এই জেলার বেশিরভাগ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা । এখানে ৯৮.৪৯ শতাংশ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। তবে এখানে হিন্দি ও সাঁওতালি সহ বিভিন্ন ভাষা প্রচলিত আছে।
মুর্শিদাবাদ জেলার দর্শনীয় স্থান
এই জেলায় বেশকিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে। যেমন – কাঠগোলা বাগান, কিরীটেশ্বরী মন্দির, জাহানকোষা, হাজার দুয়ারী রাজপ্রাসাদ, দাদপুর নীলকুঠি, নিজামত ইমামবাড়া, ব্যারাক স্কোয়ার, লালদীঘি,সাগরদিঘি, ভট্টমাটি শিবমন্দির, শেখদিঘি, জগদ্বন্ধু ধাম ইত্যাদি।
মুর্শিদাবাদ জেলার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা
এই জেলায় একাধিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে। যেমন –
১. অনুপনগর গ্রামীণ হাসপাতাল
২. আমতলা গ্রামীণ হাসপাতাল
৩. কর্ণসুবর্ণ হাসপাতাল
৪. কান্দি সাব ডিভিশন হাসপাতাল
৫. কৃষ্ণপুর গ্রামীণ হাসপাতাল ইত্যাদি।
মুর্শিদাবাদ জেলার শিক্ষা ব্যবস্থা
এই জেলার সাক্ষরতার হার ৬৬.৫৯ শতাংশ। মুর্শিদাবাদে একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যথা :-
১. রানীতলা উচ্চ বিদ্যালয়
২. পাহাড়পুর ইউনিয়ন হাই স্কুল
৩. জঙ্গিপুর উচ্চ বিদ্যালয়
৪. নবাব বাহাদুর’স ইনস্টিটিউশন
৫. নতুনগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়
৬. জলঙ্গী মহাবিদ্যালয়
৭. ডোমকল কলেজ
৮. জলঙ্গী কলেজ
৯. কান্দি রাজ কলেজ
১০. কৃষ্ণনাথ কলেজ
মুর্শিদাবাদ জেলার পরিবহন ব্যবস্থা
মুর্শিদাবাদ জেলার পরিবহন বেশ উন্নত। একাধিক ট্রেন ও বাসের ব্যবস্থা রয়েছে সাধারণ মানুষের যাতায়াতের জন্য। এছাড়াও সড়ক পথের সুবন্দোবস্ত রয়েছে।
মুর্শিদাবাদ জেলার উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি
এই জেলার কয়েকজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হলেন –
১. নবাব সিরাজউদ্দৌলা
২. নবাব মুর্শিদকুলি খান
৩. ক্ষিতীন্দ্রনাথ মজুমদার
৪. রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
৫. রাজা কৃষ্ণনাথ রায়
৬. বাবর আলী
৭. মণীশ ঘটক
৮. ফটিক চৌধুরী
৯. অরিজিৎ সিং
১০. সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
১১. শ্রেয়া ঘোষাল
১২. মীর আফসার আলী প্রমুখ।
মুর্শিদাবাদ জেলার প্রশাসনিক ব্যবস্থা
মুর্শিদাবাদ জেলা পশ্চিমবঙ্গের মালদা বিভাগের অন্তর্গত। এই জেলায় ৫ টি মহকুমা রয়েছে। যথা :- বহরমপুর সদর মহকুমা, ডোমকল মহকুমা, লালবাগ মহকুমা, কান্দি মহকুমা ও জঙ্গিপুর মহকুমা।
এছাড়াও রয়েছে ২৯ টি থানা। এই থানাগুলি ৫ টি সার্কেলে বিভক্ত। যথা :- বহরমপুর সদর সার্কেল, লালবাগ সার্কেল, ডোমকল সার্কেল, কান্দি সার্কেল ও জঙ্গিপুর সার্কেল।
মুর্শিদাবাদ জেলায় ৮ টি পৌরসভা রয়েছে। যথা :- বহরমপুর পৌরসভা, বেলডাঙ্গা পৌরসভা, ডোমকল পৌরসভা, মুর্শিদাবাদ পৌরসভা, জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ পৌরসভা, কান্দি পৌরসভা, জঙ্গিপুর পৌরসভা ও ধুলিয়ান পৌরসভা। এছাড়াও এই জেলায় রয়েছে ২৬ টি সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক।
এই জেলায় রয়েছে ৩ টি লোকসভা কেন্দ্র। যথা :- জঙ্গিপুর, বহরমপুর ও মুর্শিদাবাদ। আর রয়েছে ২৩ টি বিধানসভা কেন্দ্র। যথা :- আজিমগঞ্জ, লালগোলা, জঙ্গিপুর, ফারাক্কা, সামশেরগঞ্জ, রেজিনগর, জলঙ্গি, ডোমকল, হরিহরপাড়া, রঘুনাথগঞ্জ, সাগরদিঘী, ভগবানগোলা, রানীনগর, মুর্শিদাবাদ, নবগ্রাম, কান্দি, ভরতপুর, বেলডাঙ্গা, খরগ্রাম, বারোয়ান, বহরমপুর, নওদা ও সুতি।
Afq :
মুর্শিদাবাদ জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত ?
উঃ এই জেলা পর্যটন কেন্দ্রের জন্য বিখ্যাত।
মুর্শিদাবাদ জেলায় কয়টি ব্লক রয়েছে ?
উঃ এই জেলায় রয়েছে ২৬ টি সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক।
মুর্শিদাবাদ জেলার মহকুমা কয়টি ?
উঃ এই জেলায় ৫ টি মহকুমা রয়েছে। যথা :- বহরমপুর সদর মহকুমা, ডোমকল মহকুমা, লালবাগ মহকুমা, কান্দি মহকুমা ও জঙ্গিপুর মহকুমা।
মুর্শিদাবাদ জেলায় কয়টি থানা আছে ?
উঃ মুর্শিদাবাদ জেলায় রয়েছে ২৯ টি থানা।
মুর্শিদাবাদ জেলার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে লেখ।
উঃ এই জেলায় একাধিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে। যেমন –
১. অনুপনগর গ্রামীণ হাসপাতাল
২. আমতলা গ্রামীণ হাসপাতাল
৩. কর্ণসুবর্ণ হাসপাতাল
৪. কান্দি সাব ডিভিশন হাসপাতাল
৫. কৃষ্ণপুর গ্রামীণ হাসপাতাল ইত্যাদি।
মুর্শিদাবাদ জেলার প্রধান নদী কোনটি ?
উঃ এই জেলার প্রধান নদী ভাগীরথী।
মুর্শিদাবাদ জেলার পাহাড় সম্পর্কে লেখ।
উঃ এই জেলায় কোনও পাহাড় নেই।
মুর্শিদাবাদ জেলার পৌরসভা কয়টি ?
উঃ মুর্শিদাবাদ জেলায় ৮ টি পৌরসভা রয়েছে। যথা :- বহরমপুর পৌরসভা, বেলডাঙ্গা পৌরসভা, ডোমকল পৌরসভা, মুর্শিদাবাদ পৌরসভা, জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ পৌরসভা, কান্দি পৌরসভা, জঙ্গিপুর পৌরসভা ও ধুলিয়ান পৌরসভা।
উপসংহার :
মুর্শিদাবাদ জেলা পশ্চিমবঙ্গের মালদা বিভাগের অন্তর্গত। মুর্শিদাবাদের নাম মুর্শিদকুলি খানের নাম অনুযায়ী রাখা হয়েছিল। মুর্শিদকুলি খান এই জেলার প্রতিষ্ঠাতা। ১৭০৪ সালে এই জেলার নাম মুর্শিদাবাদ হয়। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর এই জেলা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়েছিল। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ১৭ ই আগস্ট চূড়ান্ত সীমানা নির্ধারণ করে এই জেলাকে ভারতীয় অধিসংঘে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল।