Uncategorized

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ

1 min read

পশ্চিমবঙ্গের ২৩ টি জেলার মধ্য থেকে অন্যতম হলো দক্ষিণ ২৪ পরগনা। এটি কলকাতা শহরের উত্তর পূর্ব দিকে অবস্থিত। ১৯৩৮ সাল নাগাদ এই জেলা বিভক্ত করার সুপারিশ পেশ হয়েছিল। ১৯৮৬ সালের ১ লা মার্চ ২৪ পরগনা জেলা বিভক্ত হয়। এই জেলার দক্ষিণ অংশ নিয়ে গঠিত হয়েছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা। আজ আমরা এই জেলা সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করব।

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ইতিহাস

বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থে এই জেলার উল্লেখ রয়েছে। রামায়ণের আদিকাণ্ডে সাগরদ্বীপের উল্লেখ রয়েছে। মৎস্য ও বায়ু পুরাণেও একই অঞ্চলের উল্লেখ রয়েছে। এই অঞ্চলেই কপিল মুনির আশ্রম। এছাড়াও গ্রীক ও রোমান লেখকদের রচনাতেও এই ধরনের অঞ্চলের উল্লেখ রয়েছে। এই জেলার ডায়মন্ড মহাকুমার দেউল পোতা ও হরিনারায়নপুরে প্রস্তর যুগের বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গেছে। যা থেকে বোঝা যায় এই অঞ্চলে আদিম যুগেও মানুষ বসবাস করত।

তবে ১৭৫৯ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই অঞ্চলে লর্ড ক্লাইভ কে পাঠিয়েছিল ২৪ টি পরগনার জায়গীরদার হিসেবে। এর সাথে সেই সময় যুক্ত ছিল সুন্দরবনের বেশ কিছুটা অংশ। ১৭৭০ সালে জঙ্গল কেটে সুন্দরবনে বসতি স্থাপন হয়। আর শুরু হয় চাষাবাদ। ১৭৭৪ সালে মৃত্যু হয় লর্ড ক্লাইভের। এরপর ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নীতি চালু করেন। আর এর ফলে পরগনা ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে যায়।

১৮২২ সালে সুন্দরবনকে লট ও প্লটে ভাগ করে দেওয়া হয়। ১৯৮৩ সালে ড. অশোক মিত্র প্রশাসনিক সুবিধার জন্য এই জেলাকে ভাগ করার সুপারিশ পেশ করেন। আর ১৯৮৬ সালের ১ লা মার্চ উত্তর ২৪ পরগনা আর দক্ষিণ ২৪ পরগণায় ভাগ হয়ে যায় এই জেলা। এই দুটি জেলায় বর্তমানে প্রেসিডেন্সি বিভাগের অন্তর্গত।

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার অবস্থান

এই জেলের উত্তর দিকে কলকাতা আর উত্তর ২৪ পরগনা জেলা। আবার দক্ষিণ দিকে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। পূর্ব দিকে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ অবস্থিত এবং পশ্চিম দিকে রয়েছে হুগলি নদী।

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার জনসংখ্যা

জনসংখ্যার দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা এটি। আর ভারতের মোট ৭৩৯ টি জেলার মধ্যে থেকে জনসংখ্যার নিরিখে এই জেলার স্থান হয়েছে ষষ্ঠ। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী এই জেলার মোট জনসংখ্যা ৮১ লাখ ৬১ হাজার ৯৬১ জন। এই জেলার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৮১৯ জন। এই যে লাল লিঙ্গানুপাত ১০০০ : ৯৪৯ (পুরুষ : মহিলা)।

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ভূপ্রকৃতি

এই জেলাটি ২২° ১২’ ১৩” ও ২২° ৪৬’ ৫৫” উত্তর অক্ষাংশ। আর ৮৭° ৫৮’ ৮৮” ও ৮৮° ২২’ ১০” পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। এই জেলার মোট আয়তন ৯ হাজার ৯৬০ বর্গ কিলোমিটার। দক্ষিণ ২৪ পরগনা সিন্ধু গাঙ্গেয় সমভূমির দক্ষিণাঞ্চলের গাঙ্গেয় বদ্বীপের অংশ।

এটি কোয়ার্টার্নারি অবকল্পের পলি দ্বারা গঠিত। এই বঙ্গীয় অববাহিকার উৎপত্তি হয়েছে ভারতীয় আর ইউরেশীয় ভূ-গাঠঠনিক পাতের সংঘর্ষের কারণে। এই জেলার বেশিরভাগ অংশই পলি গঠিত সমভূমি। তবে উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে সামান্য ঢাল রয়েছে।

এই জেলায় রয়েছে দুটি স্বতন্ত্র প্রাকৃতিক অঞ্চল। এই জেলার দক্ষিণ পূর্ব অংশ সুন্দরবনের সক্রিয় বদ্বীপ অঞ্চলের অন্তর্গত। বর্তমানে এই কাজ এখনও চলছে। সমুদ্রতল থেকে এই জেলার গড় উচ্চতা ৩ মিটার থেকে ৪ মিটার। জোয়ারের সময় এই অঞ্চলে সমুদ্রের জল ঢুকে পড়ে। এই জেলার মাটি লবণাক্ত প্রকৃতির।

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার জলবায়ু

এই জেলা গ্রীষ্ম মন্ডলের অন্তর্গত। তাই এখানকার জলবায়ু উষ্ণ এবং শুষ্ক। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস -এর আশেপাশে আর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা থাকে ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের আশেপাশে। এই জেলায় সর্বাধিক বৃষ্টিপাত হয় বর্ষাকালে। উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১ হাজার ৫৭৯ মিলিমিটার।

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার নদ-নদী

এই জেলায় একাধিক নদী বয়ে গেছে। যেমন – ইছামতি, হুগলি, বিদ্যাধরী, যমুনা, মাতলা ও পিয়ালী ইত্যাদি।

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার অর্থনীতি

২০০৫ সালের গ্রামীণ গৃহস্থালি সমীক্ষা অনুযায়ী, এই জেলার ৩৪.১১ শতাংশ মানুষ দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করছে। এটি ভারতবর্ষের অনুন্নত অঞ্চলের তালিকার অন্তর্গত। অনুন্নত অঞ্চল অনুদান তহবিল থেকে এই জেলায় আর্থিক সাহায্য আসে।

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার অরণ্য

এই জেলার মাটি লবণাক্ত আর কাদা প্রকৃতি। ফলে এখানে শ্বাসমূল ও শ্বাসমূল যুক্ত ম্যানগ্রোভ অরণ্য গড়ে উঠেছে। এই বনাঞ্চলের নাম বাদাবন। এই অঞ্চলে সুন্দরী, গরান, দেওয়া, বাইন, হোগলা, গোলদাদ, সিংড়া, বাদাল প্রভৃতি গাছ রয়েছে।

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা

এই জেলায় একাধিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় মোট ৪ টি সরকারি হাসপাতাল রয়েছে আর ২১ টি গ্রামীণ হাসপাতাল রয়েছে। এই জেলায় মোট ৬৯১ জন চিকিৎসক রয়েছেন।

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার শিক্ষা ব্যবস্থা

এই জেলার সাক্ষরতার হার ৭৭.৫১ শতাংশ। এই জেলার আলিপুর মহকুমার সাক্ষরতার হার ৮১.১৪ শতাংশ। আর কাকদ্বীপ মহকুমার সাক্ষরতার হার ৮২.০৪ শতাংশ। অপরদিকে বারুইপুর মহকুমা ও ক্যানিং মহকুমার সাক্ষরতার হার যথাক্রমে ৭৭.৪৫ শতাংশ ও ৭০.৯৮ শতাংশ। এছাড়া ডায়মন্ড হারবার মহকুমার সাক্ষরতার হার ৭৬.২৬ শতাংশ। এই জেলার কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম হল – ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়, ডায়মন্ড হারবার সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল আর নেওটিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। এই জেলায় মোট ৩ হাজার ৭৫৬ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৫০১ টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে।

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার পরিবহন ব্যবস্থা

এই জেলায় উন্নত সড়ক পরিবহনের পাশাপাশি রয়েছে রেলপথের সুবন্দোবস্ত। যেমন – কাকদ্বীপ রেলস্টেশন, লক্ষ্মীপুর রেলস্টেশন, জয়নগর রেলস্টেশন, ডায়মন্ড হারবার রেলস্টেশন, বারুইপুর রেলস্টেশন, নিউ আলিপুর রেলস্টেশন ইত্যাদি।

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি

এই জেলার সাথে সম্পর্কযুক্ত উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা হলেন –

১. রাজনারায়ণ বসু – শিক্ষাবিদ, ব্রাহ্ম নেতা ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদ।
২. প্রিয়নাথ কর – সমাজ সংস্কারক।
৩. শিবনাথ শাস্ত্রী – সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ ও সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতা।
৪. জানকীনাথ বসু – আইনজীবী।‌
৫. হেমন্ত মুখোপাধ্যায় – সুরকার, সংগীত পরিচালক, চলচ্চিত্র প্রযোজক ও সংগীত শিল্পী।

এছাড়াও রয়েছেন – শরৎ চন্দ্র দেব, নীলরতন সরকার, লজ্জাবতী বসু, মতিলাল বসু, বেলা মিত্র, কালীচরণ ঘোষ, সলিল চৌধুরী, সৌরভ গাঙ্গুলি প্রমুখ।

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার প্রশাসনিক ব্যবস্থা

এই জেলার সদর শহর আলীপুর। এই জেলায় ৫ টি মহকুমা রয়েছে। যথা :- ডায়মন্ড হারবার, ক্যানিং, আলিপুর, বারুইপুর ও কাকদ্বীপ। এই জেলায় মোট ৩৩ টি থানা আর ৩১২ টি গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে।

এছাড়াও এই জেলায় রয়েছে ৭ টি পৌরসভা আর ২৯ টি সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক। এই জেলায় মোট ৩৭ টি দ্বীপ রয়েছে। লোকসভা কেন্দ্র রয়েছে ৫ টি। যথা :- দক্ষিণ কলকাতা (আংশিক), জয়নগর, ডায়মন্ড হারবার, যাদবপুর (আংশিক) ও মথুরাপুর। আর ২৫ টি বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে।

Afq :

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত ?

উঃ এই জেলা ম্যানগ্রোভ অরণ্যের জন্য বিখ্যাত।

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় কয়টি লোকসভা কেন্দ্র রয়েছে ?

উঃ লোকসভা কেন্দ্র রয়েছে ৫ টি। যথা :- দক্ষিণ কলকাতা (আংশিক), জয়নগর, ডায়মন্ড হারবার, যাদবপুর (আংশিক) ও মথুরাপুর।

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার মহকুমা কয়টি ?

উঃ এই জেলায় ৫ টি মহকুমা রয়েছে। যথা :- ডায়মন্ড হারবার, ক্যানিং, আলিপুর, বারুইপুর ও কাকদ্বীপ।

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় কয়টি থানা আছে ?

উঃ এই জেলায় মোট ৩৩ টি থানা রয়েছে।

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে লেখ।

উঃ এই জেলায় একাধিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় মোট ৪ টি সরকারি হাসপাতাল রয়েছে আর ২১ টি গ্রামীণ হাসপাতাল রয়েছে। এই জেলায় মোট ৬৯১ জন চিকিৎসক রয়েছেন।

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার প্রধান নদী কোনটি ?

উঃ এই জেলায় একাধিক নদী বয়ে গেছে। যেমন – ইছামতি, হুগলি, বিদ্যাধরী, যমুনা, মাতলা ও পিয়ালী ইত্যাদি। এই সব কটি নদীই দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার প্রধান নদী।

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার পাহাড় কোনটি ?

উঃ এই জেলায় কোনও পাহাড় নেই।

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার পৌরসভা কয়টি ?

উঃ এই জেলায় রয়েছে ৭ টি পৌরসভা।

উপসংহার :

পশ্চিমবঙ্গের ২৩ টি জেলার মধ্য থেকে অন্যতম হলো দক্ষিণ ২৪ পরগনা। এই জেলায় মোট ৩ হাজার ৭৫৬ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৫০১ টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। ২০০৫ সালের গ্রামীণ গৃহস্থালি সমীক্ষা অনুযায়ী, এই জেলার ৩৪.১১ শতাংশ মানুষ দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করছে। এটি ভারতবর্ষের অনুন্নত অঞ্চলের তালিকার অন্তর্গত। সমুদ্রতল থেকে এই জেলার গড় উচ্চতা ৩ মিটার থেকে ৪ মিটার। এই জেলায় মোট ৬৯১ জন চিকিৎসক রয়েছেন। এই জেলার সাক্ষরতার হার ৭৭.৫১ শতাংশ। এই জেলের উত্তর দিকে কলকাতা আর উত্তর ২৪ পরগনা জেলা। আবার দক্ষিণ দিকে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। পূর্ব দিকে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ অবস্থিত এবং পশ্চিম দিকে হুগলি নদী।

Aindrila Dhani

Leave a Comment