পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি বিভাগের একটি জেলা হল কালিম্পং। এই জেলার সদর শহর কালিম্পং, পাহাড়ে ঘেরা অপরুপ সুন্দর একটি জায়গা। সারাবছর এখানে পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। এটি নিম্ন হিমালয়ে অবস্থিত। এর গড় উচ্চতা ১ হাজার ২৫০ মিটার। এই জেলা সম্পর্কেই আজ বিস্তারিত আলোচনা হবে।
কালিম্পং জেলার ইতিহাস
কালিম্পং জেলা একসময় সিকিমের অংশ ছিল। ১৭৮০ সালে এটি ভুটান রাজ্যের অধিকারে চলে যায়। আর পরবর্তী ১৫০ বছর এটি ভুটানেরই অংশ ছিল। এরপর ১৮৬৪ সালে এংলো ভুটান যুদ্ধ হয়। এই অঞ্চল একসময় পশ্চিম ডুয়ার্সের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৮৬৬ সালে তা হস্তান্তরিত হয় দার্জিলিং জেলায়। সেই সময় অবশ্য কালিম্পং একটি ছোট গ্রাম ছিল।
১৮৭০ সালে এই অঞ্চলে প্রথম বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। আর ১৯০৭ সালে ভারতীয়রা স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায়। ১৯১১ সালে লেপচা, নেপালি, মুসলমান সহ অন্যান্য জাতির বসবাস শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর এটি পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত হয়। ২০১৭ সালের ১৪ ই ফেব্রুয়ারি দার্জিলিং থেকে পৃথক হয়ে কালিম্পং একটি আলাদা জেলা হিসেবে গঠিত হয়।
কালিম্পং জেলার অবস্থান
এটি তিস্তা নদীর ধারে অবস্থিত। পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি বিভাগের একটি জেলা হল কালিম্পং। এই জেলার সদর শহর কালিম্পং, পাহাড়ে ঘেরা অপরুপ সুন্দর একটি জায়গা। সারাবছর এখানে পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। এটি নিম্ন হিমালয়ে অবস্থিত। এর গড় উচ্চতা ১ হাজার ২৫০ মিটার। এই জেলার সদর শহর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ২৭ মাউন্টেন ডিভিশনে অবস্থিত।
কালিম্পং জেলার জনসংখ্যা
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী এখানকার মোট জনসংখ্যা ২ লাখ ৫১ হাজার ৬৪২ জন। এখানে প্রায় ৬১ শতাংশ মানুষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। আর বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ প্রায় ২১ শতাংশ। এছাড়াও ১৫ শতাংশ মানুষ খ্রিস্টান ধর্মমত পালন করেন। আর মুসলিম ধর্মমত এখানকার প্রায় ২ শতাংশ মানুষ পালন করেন।
১৯৫১ সালে এখানকার ২৪ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা নেপালি ছিল। ২০১১ সালের জনগণায় তা বৃদ্ধি পেয়ে ৮৭.৬১ শতাংশ হয়েছে।
কালিম্পং জেলার ভূপ্রকৃতি
কালিম্পং জেলার সদর শহর হল কালিম্পং। এটি পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট শহর। তাই স্বাভাবিক ভাবেই এখানকার ভূমিতে উঁচু নীচু ঢাল রয়েছে। তবে এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশের কোনো তুলনা হয় না।
কালিম্পং জেলার জলবায়ু
এখানে বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত ও বর্ষা ঋতু লক্ষ করা যায়। এখানকার সর্বোচ্চ বার্ষিক তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে আর সর্বনিম্ন বার্ষিক তাপমাত্রা ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে। বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টিপাত হওয়ায় কারণে অনেকসময় ধ্বস নামে।
কালিম্পং জেলার নদ-নদী
কালিম্পং একটি পাহাড়ী এলাকা। এখানে একাধিক নদী প্রবাহিত হয়ে চলেছে। যথা :- রামবং নদী, রেচি নদী, নুন চু নদী, রাংলো নদী, চামাং নদী, রেল্লিখোলা নদী, তিস্তা নদী, চেল নদী, ডালিং নদী, ঘিস নদী, নেওড়া নদী, লিস নদী ইত্যাদি। তবে এখানকার প্রধান নদী হল জলঢাকা।
কালিম্পং জেলার অভয়ারণ্য
এই জেলায় একটি জাতীয় উদ্যান রয়েছে। এটির নাম নেওড়া উপত্যকা জাতীয় উদ্যান। এই উদ্যানের আয়তন ১৫৯.৮৯ কিলোমিটার। এখানে বিভিন্ন ধরনের গাছপালার পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন জীবজন্তু। এখানে রয়েছে ভারতীয় চিতা, লাল পান্ডা, মেঘলা চিতা, এশীয় সোনালী বিড়াল, দেশি বুনো শুয়োর, শ্লথ ভাল্লুক, চিতা বিড়াল, ঘোরল, মেঘলা চিতা ইত্যাদি।
কালিম্পং জেলার দর্শনীয় স্থান
শৈলশহর কালিম্পং -এ পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো বেশকিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে। যেমন –
ডেলো পাহাড় :- এটি কালিম্পং -এর সবথেকে উঁচু পয়েন্ট। ঠিক ছবির মতো গোছানো একটি জায়গা। এখানে রোপওয়ের ব্যবস্থা আছে।
তিস্তা বাজার :- যেকোনো জায়গায় ঘুরতে গেলে সেখানকার স্মৃতি হিসেবে কিছু না কিনে কি আর ফেরা যায়? কালিম্পং এর তিস্তা বাজার থেকে সস্তায় পছন্দ মতো জিনিস পেয়ে যাবেন পর্যটকরা। তবে এই বাজারে সবসময় ভীড় থাকে। সবথেকে বেশি ভীড় তো পর্যটকদেরই থাকে।
রোমান ক্যাথলিক চার্চ :- খুবই শান্ত একটি জায়গা হল রোমান ক্যাথলিক চার্চ। সারাদিনের হৈচৈ এর শেষে এখানে গেলে মন ভালো হয়ে যাবে আপনাদের।
সায়েন্স সিটি :- এটি বর্তমান যুগে পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। বাচ্চাদের চড়ার মতো বেশকিছু রাইড রয়েছে এখানে।
গল্ফ কোর্স :- যাঁরা প্রকৃতির কোলে থাকতে ভালোবাসেন তাঁদের জন্য গল্ফ কোর্স সবথেকে সেরা জায়গা। এখানে গেলে প্রকৃতির মাঝে আপনারা হারিয়ে যাবেন।
এছাড়াও রয়েছে – পাইনভিউ নার্সারি, হনুমান মন্দির, লেপচা মিউজিয়াম, জ্যাং ঢোক পালরী ফোডাং, টসোঙ্গাঁ গুম্ফা, মর্গ্যান হাউস, ম্যাক ফারলেন চার্চ, কালিম্পং আর্টস এন্ড ক্রাফ্ট সেন্টার, লোলেগাঁও ইত্যাদি।
কালিম্পং জেলার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা
এখানে সাধারণ মানুষের চিকিৎসার জন্য একাধিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে। যেমন – আর্মি হসপিটাল, কালিম্পং জেলা হসপিটাল ও সেবা সদন হসপিটাল।
কালিম্পং জেলার শিক্ষা ব্যবস্থা
এখানকার অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ আমলে স্থাপিত। কালিম্পং -এ বোর্ডিং স্কুলও রয়েছে। এইসব স্কুলে সমতলের বহু ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করে। যেমন – ড. গ্রাহাম হোমস্ স্কুল, রকভ্যালে একাডেমী, সেন্ট জোসেফস্ একাডেমী ইত্যাদি। এছাড়াও রয়েছে কালিম্পং গার্লস হাই স্কুল, নারায়ণা স্কুল, কালিম্পং গর্ভমেন্ট হাই স্কুল ইত্যাদি।
কালিম্পং জেলার পরিবহন ব্যবস্থা
কালিম্পং -এ যাতায়াতের সুব্যবস্থা রয়েছে। দার্জিলিং মেল, পদাতিক এক্সপ্রেস, কামরূপ এক্সপ্রেস, কাঞ্চন কন্যা এক্সপ্রেস ইত্যাদির মাধ্যমে কালিম্পং যাওয়া যায়। এছাড়াও বাস ও এরোপ্লেনের মাধ্যমেও যাওয়া সম্ভব।
কালিম্পং জেলার নামকরণ
এই জেলার নামকরণ হয়েছে কালিম্পং শহর অনুযায়ী। তবে কালিম্পং নামের সঠিক উৎস এখনও জানা যায়নি। জানা যায়, তিব্বতি ভাষায় ‘কালিম্পং’ কথার অর্থ রাজার মন্ত্রীদের সভা। আর লেপচা ভাষায় ‘কালিম্পং’ কথার অর্থ যে শৈলশিরায় খেলা করা হয়। এই অঞ্চলে আগে গ্রীষ্মকালীন ক্রীড়া অনুষ্ঠিত হত। তবে পাহাড়ের আদিবাসীরা এই জেলাকে ‘কালিবং’ বলে থাকেন। যার অর্থ কালো নাল।
কালিম্পং জেলার প্রশাসনিক ব্যবস্থা
কালিম্পং জলপাইগুড়ি বিভাগের একটি জেলা। এই জেলার সদর শহর হল কালিম্পং। এই জেলার একটিমাত্র মহকুমা – কালিম্পং মহকুমা। কালিম্পং পৌরসভায় ৩ টি ব্লক রয়েছে। যথা :- গোরুবাথান, কালিম্পং ১ ও কালিম্পং ২।
এছাড়াও রয়েছে ৪২ টি গ্রাম পঞ্চায়েত। তাঁর মধ্যে থেকে ১৮ টি গ্রাম পঞ্চায়েত কালিম্পং ১ নং ব্লকের অন্তর্গত। আর ১৩ টি গ্রাম পঞ্চায়েত কালিম্পং ২ নং ব্লকের অন্তর্গত। বাকি ১১ টি গ্রাম পঞ্চায়েত গোরুবাথান ব্লকের অন্তর্গত।
কালিম্পং জেলায় মোট ৩ টি থানা আছে। কালিম্পং ১ নং ব্লকে রয়েছে কালিম্পং থানা। তবে কালিম্পং ২ নং ব্লকে কোনো থানা নেই। আর গোরুবাথান ব্লকে রয়েছে ২ টি থানা। যথা :- জলঢাকা ও গোরুবাথান।
Afq :
কালিম্পং জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত ?
উঃ কালিম্পং জেলা পর্যটনের জন্য বিখ্যাত।
কালিম্পং জেলায় কয়টি ব্লক রয়েছে ?
উঃ কালিম্পং জেলায় ৩ টি ব্লক রয়েছে। যথা :- গোরুবাথান, কালিম্পং ১ ও কালিম্পং ২।
কালিম্পং জেলার মহকুমা কয়টি ?
উঃ এই জেলার একটিমাত্র মহকুমা – কালিম্পং মহকুমা।
কালিম্পং জেলায় কয়টি থানা আছে ?
উঃ কালিম্পং জেলায় মোট ৩ টি থানা আছে। কালিম্পং ১ নং ব্লকে রয়েছে কালিম্পং থানা। তবে কালিম্পং ২ নং ব্লকে কোনো থানা নেই। আর গোরুবাথান ব্লকে রয়েছে ২ টি থানা। যথা :- জলঢাকা ও গোরুবাথান।
কালিম্পং জেলার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে লেখ।
উঃ এখানে সাধারণ মানুষের চিকিৎসার জন্য একাধিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে। যেমন – আর্মি হসপিটাল, কালিম্পং জেলা হসপিটাল ও সেবা সদন হসপিটাল।
কালিম্পং জেলার প্রধান নদী কোনটি ?
উঃ এখানকার প্রধান নদী হল জলঢাকা।
কালিম্পং জেলার পাহাড় সম্পর্কে লেখ।
উঃ এটি নিম্ন হিমালয়ে অবস্থিত। এখানে ডেলো পাহাড় সহ বেশকিছু ছোটো বড়ো পাহাড় রয়েছে।
কালিম্পং জেলার পৌরসভা কয়টি ?
উঃ এই জেলায় একটিমাত্র পৌরসভা রয়েছে। যেটি হল- কালিম্পং।
উপসংহার
পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি বিভাগের একটি জেলা হল কালিম্পং। এই জেলার সদর শহর কালিম্পং, পাহাড়ে ঘেরা অপরুপ সুন্দর একটি জায়গা। এই জেলার নামকরণ হয়েছে কালিম্পং শহর অনুযায়ী। তবে কালিম্পং নামের সঠিক উৎস এখনও জানা যায়নি। জানা যায়, তিব্বতি ভাষায় ‘কালিম্পং’ কথার অর্থ রাজার মন্ত্রীদের সভা।
আর লেপচা ভাষায় ‘কালিম্পং’ কথার অর্থ যে শৈলশিরায় খেলা করা হয়। এই অঞ্চলে আগে গ্রীষ্মকালীন ক্রীড়া অনুষ্ঠিত হত। তবে পাহাড়ের আদিবাসীরা এই জেলাকে ‘কালিবং’ বলে থাকেন। যার অর্থ কালো নাল। ১৮৭০ সালে এই অঞ্চলে প্রথম বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। আর ১৯০৭ সালে ভারতীয়রা স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায়। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর এটি পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত হয়। ২০১৭ সালের ১৪ ই ফেব্রুয়ারি দার্জিলিং থেকে পৃথক হয়ে কালিম্পং একটি আলাদা জেলা হিসেবে গঠিত হয়।